পিসিমা নিশুত রাতে এসে বলল আর্লাপ:করলি বুঝি?
না। আমি ওকে ধমকে দিয়েছি।
পিসিমা খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, বেশ করেছিস। প্রথম প্রথম একটু কড়া হওয়া ভাল। তাতেই হামলে পড়বে। যা হ্যাংলা হয় পুরুষেরা! আস্তে আস্তে সুতো ছাড়বি। খেলিয়ে খেলিয়ে তুলবি। তারপর ঘরে এনে কপাট বন্ধ করে চিবিয়ে খা। ছিবড়ে করে ফেল।
আমি কানে হাত চাপা দিলাম।
অনেক সতী দেখেছি লো। পেটে খিদে মুখে লাজ। কাল সবুজ রেশমের কাপড়খানা পরিস। বেশ দেখায় তোকে। অত ডগন্ডগে করে সিঁদুর দিস কেন? একটু এয়োর চিহ্ন রাখলেই হয়।
আপনি যান পিসিমা।
কেন যাব? তোর বাপেরটা খাই না পরি? ওরে শোন, শ্রীরাধিকাও তোর চেয়ে কম ছিল না। তা বলে কি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ফস্টি নস্টি করত না? দোষ হলে করত ওরকম?
আমার বুকে কেমন জ্বালা করছিল। সারা রাত আমি চেয়ে জেগে রইলাম। ছেলেটা কী চায়? কেন আসে?
পরদিনও ছেলেটা পিছু নিল। তবে অনেক দূর থেকে। তাকে আমি দেখতে পেলাম। আমার কান্না পাচ্ছিল। কেন কষ্ট করছে ছেলেটা? কেন অপমান সইতে আসে? কী লাভ ওর?
দুদিন পর একটু বৃষ্টি হল। গ্রীষ্ম শেষের প্রথম বৃষ্টি। পথঘাট ভিজল। বাতাস ঠাণ্ডা হল।
মেঘ কেটে অপরূপ এক চাঁদ উঠল আকাশে। রোজকার চাঁদ নয়। এ যেন রূপকথার জগৎ থেকে আমাদের আকাশে ভেসে এল। গাছের পাতায়, ভেজা পথে, ছোটো ছোটো জমা জলের গর্তে ছড়িয়ে দিল হাজারো টুকরো।
পথে পা দিয়েই আমি বুঝলাম, আজ বড় মাতাল দিন। আজ যেন বাঁধ মানছে না সুন্দর। আজ বড় বাড়াবাড়ি। আজ উতরোল হাওয়া। আজ কেউ বশ মানছে না যেন। আজ সব ওলটপালট। আজ কোন কারিগর পুরোনো পৃথিবীর সব মালমশলা নতুন করে ছেনে মেখে গড়েছে অন্য একটা জগৎ। আকাশে এত তারা তো থাকে না কখনও? আমি কি উড়ে যাচ্ছি হাওয়ায়, জ্যোৎস্নায়?
আমি আজ নরম করে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, পিছনের পথে কেউ নেই। সে আজ পিছু নেয়নি আমার? এই জ্যোৎস্নার পাগল রাতে সে এল না বুঝি? আজ যেন আমারও একটু প্রতীক্ষা ছিল! মনটা একটু ম্লান আর বিস্বাদ হয়ে গেল কি? অভ্যাস তো!
আমি শূন্য পথটাকে একটা অস্পষ্ট ধিক্কার দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছিলাম। আস্তেই হাঁটা যাক। হয়তো সে আসবে। হয়তো সময় যায়নি।
সে পিছনে ছিল না। ছিল সামনে। হঠাৎ আমাকে আপাদমস্তক চমকে দিয়ে সে নির্জন পথে আমার পথ জুড়ে দাঁড়াল। দীঘল চেহারা, দুটি অপরূপ হরিণের চোখ, মাথায় মস্ত চাঁদ। আমি মুগ্ধ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি কখন! লজ্জাহীন চোখে তাকিয়ে আছি। দুটি চোখে কী গভীর মায়া! দুটি ঠোঁটে কী অফুরান আকুলতা!
সে আমার দিকে অপলক চেয়ে ছিল। কিছুক্ষণ স্তব্ধতাই তরঙ্গ তুলে যাতায়াত করছিল দুজনের মধ্যে।
সে হঠাৎ স্খলিত কণ্ঠে বলল, আমি… আমি তোমাকে ভালবাসি।
তারপর আর সে দাঁড়াতে পারল না। একটা ভীষণ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সে দ্রুত ভীত পায়ে উধাও হয়ে গেল। জবাব চাইল না। তাকে আমার জবাব দেওয়ারও কিছু ছিল না হয়তো। কিন্তু আমার ভিতরে যে ভেঙে পড়ছে ইমারত! ধসে পড়ছে পাহাড় পর্বত! হারিয়ে যাচ্ছে পথ!
খুব ধীর পায়ে, যেন কোথাও যাচ্ছি না, কোনওদিন পৌঁছব না কোথাও, এরকমভাবে হেঁটে আমি বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির দরজাটা চিনতে পর্যন্ত সময় লাগল। এই কি আমার ঘরবাড়ি? এই কি আমার ঠিকানা?
বালিশ ভিজিয়ে কাঁদলাম রাতে।
পিসিমা প্রগাঢ় স্বরে বললেন, কাঁদ! কাঁদলে অনেক ময়লা কেটে যায়। ধর্মকর্ম বারব্রত জাত ধর্ম ওসব হল ময়লা। সব পরিষ্কার হয়ে যাক। তারপর গাঙ্ পেরিয়ে যা। কত সুখ, দেখবি।
সুখ পিসিমা! আমার যে ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে।
খাক হয়ে যাক। পুড়ে যাক জঞ্জাল।
আমি সারা রাত জ্বালা-ধরা চোখে অন্ধকারে চেয়ে রইলাম।
পরদিন ভোরবেলা উঠে সদর দরজাটি খুলতেই দেখি দরজার বাইরে চৌকাঠের পাশটিতে কে একটি বৃষ্টিভেজা রক্তগোলাপ রেখে গেছে। কয়েকটা সবুজ পাতা আর ডাঁটিশুন্ধু। তখনও ফোটেনি। আধফোটা।
আমি ফুলটা তুলে নিলাম। এনে জলে ভিজিয়ে সাজিয়ে রাখলাম ঘরে। ফুটুক। ফুলটা ফুটুক।
প্রতিদিন পিছু নিত সে। প্রতি সকালেই রেখে যেত রক্তগোলাপ। আমার কি পাপ হল? আমি কি মনে মনে আমার শক্ত বাঁধন কেটে নৌকো ভাসালাম পাগলা স্রোতে?
ভোরবেলা একদিন আমার ক্লান্ত স্বামী ফিরলেন। দরজা খুলে আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম, আপনি! কোথায় ছিলেন আপনি এতদিন? কেন ছেড়ে থাকেন আমাকে?
বলতে বলতে আমি কেঁদে ফেললাম। বারবার মাথা ঠুকতে লাগলাম ওঁর বুকে।
উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আরে, কী কাণ্ড! কেঁদো না, কেঁদো না। আমি তো কাজেই গিয়েছিলাম।
আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না আর।
রক্তগোলাপটি আজও রাখা ছিল চৌকাঠে। আমার স্বামী না দেখে সেটিকে পদপিষ্ট করে চৌকাঠ ডিঙিয়ে এলেন।
আজ আর আমি গোলাপটি তুলে নিলাম না।
রাতে আমি নতুন চাদর পাতলাম বিছানায়। পরিপাটি করে পেতে দিলাম বালিশ। ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিলাম। একটু সুগন্ধও।
উনি শুতে এসে বিছানার দিকে চেয়ে বললেন, আজ কি ফুলশয্যা?
আমি তৃষিতের মতো তাঁকে আলিঙ্গন করলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম, আমাকে দিন।
কী কাণ্ড লতা? আমার সবই তো তোমার।
আমি আপনাকে আরও চাই। আরও চাই। আপনাকে দিন।
ঘরের চারদিকে অশান্ত এক কণ্ঠস্বর ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাপ করলি না? অভিসার হল না তোর? ওলাউঠা হয়ে মর সান্নিপাতিক হয়ে মর। আমি কালসাপ হয়ে তোর বরকে খাব। মরবি, মরবি।