আমার স্বামী আগের মতো অলস নেই। তিনি সদা-প্রস্তুত, তৎপর। আমাদের মাল আসে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সরাসরি তাঁতি বা মিলের সঙ্গে আমাদের কারবার। আমার স্বামীকে তাই খুব বাইরে যেতে হয় আজকাল। দূরেও। তখন সকালে দোকানে থাকেন আমার শ্বশুর, বিকেলে আমি।
সেবার আমার স্বামী গেছেন দক্ষিণ ভারতে। এক ঝড়ের রাতে একা ঘরে শুয়ে হঠাৎ খুব বিগলিত স্বর শুনতে পেলাম।
শুনছিস!
শুনছি।
তোর সঙ্গে রোজ পিছু পিছু একটা ছেলে আসে। দেখেছিস তাকে?
চমকে উঠে বলি, না তো! কে ছেলে? কখন আসে?
ন্যাকা! জানে না! রোজ রাতে যখন দোকান থেকে ফিরিস তখন পিছু পিছু ওটা কে আসে? বুঝি না নাকি?
আমি দেখিনি কাউকে।
সুন্দর ছেলে। চিবিয়ে খা। পেট পুরে খা। সাধ মিটিয়ে খা। পাপ পুণ্য বলে দুনিয়ায় কিছু নেই। সতী না হাতি। সব ভাসিয়ে দে। খা।
আমার বুক ঢিবঢিব করছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ।
তোর এমন রূপ, তবু মেথরানির মতো সেজে থাকিস কেন? মাথায় চিরুনি নেই, সাজে বাহার নেই, যেন অলক্ষ্মী মূর্তি ঘরে এলেন। কেন রে বোকা মেয়ে, স্বামী ছাড়া আর বুঝি পুরুষমানুষ নেই?
চুপ করুন পিসিমা। শুনলেও পাপ হয়।
আহা, একেবারে সতী সাবিত্রী এলেন! সাজিস না কেন? ঠোঁটে একটু রং দিবি, চোখে কাজল টানবি, চুলটা পরিপাটি করে বাঁধবি, ভাল একখানা ঝলমলে শাড়ি পরবি, তবে না! যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটবি, চারদিকে ঢেউ উঠবে।
ছিঃ পিসিমা।
অত ছিছিকার করতে হবে না। অমন চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে, বঞ্চিত করবি কেন রে ভাতারখাকি? পাপ টাপ বলে কিছু আছে নাকি? বরং শরীরকে বঞ্চিত করাই তো পাপ।
আর বলবেন না, আমি আর শুনতে চাই না।
পিসিমা খিলখিল করে ঠাণ্ডা হাসিতে ঘর ভরে দিলেন। সেই হাসির শীতলতায় আমার বুক হিম হয়ে গেল।
পরদিন দোকান থেকে যখন ফিরছি তখন পথঘাট কিছুটা নির্জন। এ সময়টায় মফস্বল শহরে বেশি লোক বাইরে থাকে না। হাঁটছি সামনের দিকে চেয়ে, মনটা পিছনদিকে। কেউ আসছে? কেউ কি সত্যিই পিছু নেয় আমার?
আচমকা পিছু ফিরে চাইলাম। আর তখনই দেখতে পেলাম তাকে। লম্বা, দীঘল চেহারার একটা ছেলে। পরনে পায়জামা আর পানজাবি। এলোমেলো একরাশ চুল মাথায়। অল্প একটু দাড়ি। পাশের দোকানের উজ্জ্বল আলোর ভিতর দিয়ে আসছিল বলে তার মুখখানা স্পষ্ট দেখলাম। আমার স্বামী সুপুরুষ বটে, এরকম মায়াবী চেহারা তাঁর নয়। তাঁর চেহারায় জমিদারির আভিজাত্য প্রবল। এ যেন কবিতার মতো। কী দীঘল হরিণের মতো দুখানা চোখ। কী মিষ্টি এর দুখানা ঠোঁট! সে আমার দিকেই চেয়ে খুব ধীর পায়ে হেঁটে আসছিল।
উত্তাল বুকে আমি প্রায় ছুটে পথটা পার হয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
নিশুত রাতে পিসিমা বললেন, দেখলি?
ছিঃ পিসিমা।
ওরে শোন, ঘরের পুরুষ তো জলভাত। আটপৌরে কাপড়ের মতো। হাগো, মোতো, খাও, ভেঁড়েমুষে পরো। কিন্তু এসব পুরুষ হল বালুচরী বেনারসী। মাঝে মাঝে চাখতে হয়।
ছিঃ।
অমন রূপে কি একজনের নৈবেদ্য সাজাবি? তুই কী রে? দেব দেবীরাও কত কী করে বেড়াত। পড় না মহাভারতখানা, দেখবি। শরীর হল নদীর মতো, সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ধরা না পড়লেই হল। শরীর তো আর নালিশ করবে না।
আমার চোখে জল এল।
পরদিন আমি দোকানের একজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম একবারও পিছু ফিরে তাকাইনি। দিন তিনেক এরকম চলল। চারদিনের দিন ফের একা ফিরছিলাম। পাহারাদার নেওয়ার কোনও মানেই হয় না। ছেলেটা তো আর আমাকে আক্রমণ করবে না। পিছু নিলে নেবে।
কয়েক পা যেতে না যেতেই আমি টের পেলাম, পিছনে কেউ আসছে। সে-ই কি?
ঠিক আন্দাজমতো জায়গায় আমি মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম। সে-ই। আজও তার মুখে আলো পড়েছিল। বুকের ভিতরটা এমন ধক ধক করতে লাগল কেন যে!
না, আমি আজ আর ছুটলাম না। একটু কাঁপা বুক নিয়ে স্বাভাবিক হেঁটে ফিরে এলাম।
নিশুত রাতে পিসিমার বিগলিত কণ্ঠস্বর বলল, ভাল নয়? তোকে বলেছিলাম কিনা! অত লজ্জা কিসের তোর? অত তাড়াই বা কিসের? একটু ঢং করে করে হাঁটবি, মুচকি একটু হাসবি, চোখে একটু ইশারা করবি। তুই যে কিছুই শিখিসনি বোকা মেয়ে। রোজকার ভ্যাতভ্যাতে ওই একটা মাত্র আলুনি পুরুষ তোর ভাল লাগে? ভগবান তাহলে তোকে এত দিলেন কেন? এত রূপ, এত গুণ, চোখে এত দেয়ালা। একবার ডুব দিয়ে দেখ না।
আপনি কি আমাকে ছাড়বেন না পিসিমা? আমি কী দোষ করেছি?
বড় বড় কথা বলিসনি লো সাতভাতারি। ঢের চেনা আছে।
সাত দিনের মাথায় আমি আর থাকতে পারিনি। দোকান থেকে ফিরছি। একা। যখন টের পেলাম সে আজও আসছে, তখন হঠাৎ আমার সারা শরীরে রিমঝিম করে উঠল রাগ। আমি ঝটকা মেরে ঘুরে দাঁড়ালাম। ছেলেটাও থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললাম, কী চান বলুন তো! রোজ পিছু নেন কেন?
ছেলেটা এত ঘাবড়ে গেল যে, বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল শুধু। তারপর অস্ফুট স্বরে কী একটা বলে মাথা নিচু করে দ্রুত পায়ে পালিয়ে গেল।
আমার বয়স মাত্র বাইশ। ডগমগে যুবতী। কিন্তু সংসারের জন্য ভেবে ভেবে, আর নানা কাজে জড়িয়ে বয়সের কথা ভুলেই ছিলাম। যেন সাত বুড়ির এক বুড়ি। রূপের কথা ভাবি না, সাজের কথা ভাবি না, কটাক্ষ নেই। একটা মানুষকে ঘিরেই যেন আমার লতিয়ে ওঠা। কিন্তু আজ বয়স যেন ডাক দিল। ডাক দিল আমার বিস্মৃত যৌবন। আমার রূপ ফুঁসে উঠে যেন আমাকে বলল, আমরা কি বৃথা ফিরে যাব?