তোমার গলার দাগ সেরকমই একটা ঘটনার কথা বলছে কি? অমঙ্গলে মঙ্গল?
আমি আর একটু কাঁদলাম। তারপর বললাম, আমি অন্যের দীর্ঘশ্বাস শুনে সুখী হতে পারব না। আপনি ভাসুরঠাকুরের কথা কেন ভাবেন না? উনি যে দুরবস্থায় পড়েছেন।
দাদা! দাদা কেন দুরবস্থায় পড়বে! সংসার তো দিব্যি চলছে।
ওটা কী কথা হল! পুরুষমানুষের অহংকার নেই বুঝি? উনি কেন আপনার অন্নদাস হয়ে থাকবেন? ওঁকে কিছু করতে দিন।
ওঃ, দাদার জন্যই নতুন দোকান? কিন্তু ও কি পারবে?
আপনি বুঝি পারেননি?
উনি এবার আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়ে বললেন, আমি পেরেছি তোমার জোরে। আমার তো তুমি আছো, দাদার তো তা নেই।
দাদার আপনি আছেন। এ বাড়িতে দীর্ঘশ্বাস আর জমতে দেবেন না।
উনি আমার গলাটা ভাল করে দেখলেন। তারপর বললেন, আজকাল আমার কাছে কথা লুকোতে শিখছ।
আমি সাশ্রু নয়নে বললাম, না। লুকোবো না। কিন্তু সব কথারই উপযুক্ত সময় আছে। নইলে হিত কথাও বিপরীত হয়। কথারও লগ্ন আছে, দিনক্ষণ আছে। আজ নয়, সময় হলে বলব।
উনি একটা শ্বাস ফেলে বললেন, বেশ। আমি অপেক্ষা করব।
দোকান কেনার তোড়জোড় শুরু হওয়ার পর আমার শাশুড়ি আমাকে ডেকে একদিন বললেন, শুনছি তুমি তোমার ভাসুরের জন্য দোকান করে দিচ্ছ!
আমি মৃদু হেসে চুপ করে রইলাম।
উনি আমার মাথায় একটু হাত রেখে বললেন, তোমার মনটা বড় ভাল। কিন্তু একটা কথা আছে।
কী কথা?
তোমার ভাসুর এ বাড়ির আর পাঁচজন পুরুষমানুষের মতোই অহংকারী মানুষ। সে হয়তো আজ বিপাকে পড়ে তোমার দান নেবে। কিন্তু চিরকাল মনে একটা চিমটি থেকে যাবে। তাছাড়া তোমাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পয়সা, ও যদি ব্যবসায় মার খায়, তাহলে জলে যাবে।
সব ঠিক হয়ে যাবে মা।
তোমার কেবল ওই কথা। শোনো, এ বাড়ির ধাঁচ আমি ভালই জানি। আমার লুকোনো কিছু গয়না আর মোহর এখনও আছে। শেষ সম্বল। তবে ও দিয়ে আর আমার কোনও কাজ নেই। এ বাড়ির উড়নচণ্ডীদের হাত থেকে এতকাল রক্ষে করে এসেছি। তুমি এগুলো বেচে দোকানটা কেনো। তাতে তোমার ভাসুরের মনে আর কোনও কাঁটা থাকবে না।
কেন মা, শেষ সম্বল যখন, ওটা থাক না।
জমিয়ে রাখারও তো কোনও মানে নেই। বরং কাজে লাগুক, ফলন্ত হোক। অপব্যয় না হলেই হল। দোকানটা তোমার ভাসুরকে দেবে বটে, কিন্তু নিজে নজর রেখো। তোমার ভরসাতেই দিচ্ছি।
আমি আর আপত্তি করলাম না।
কথাটা জানতে পারার পর আমার ভাসুরও যেন স্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর মুখে অনাবিল হাসি দেখলাম।
দোকান খুলে ভাসুর বসলেন। আমি দুবেলা গিয়ে খুব বিনীতভাবে, খুব সন্তর্পণে তাঁকে কিছু কিছু পরামর্শ দিতে লাগলাম। উনি বিনা আপত্তিতে আমার কথামত চলতে লাগলেন। দোকানে বসে তিনি আনন্দও পাচ্ছিলেন। কেননা সারাক্ষণ দোকানে গ্রামোফোন আর টেপ রেকর্ডারে গান হয়, রেডিও চলে, একঘেয়েমি নেই।
দোকান ধীরে ধীরে চলা শুরু করল।
একদিন গভীর রাতে ঘুম থেকে কে ডেকে তুলল আমায়, চোর! চোর! চোর ঢুকছে ঘরে! ওঠ, ওঠ, ওঠ শিগগির। আমার সর্বস্ব নিয়ে যাবে যে রে হতভাগী। তোর যায় যাক, আমার গয়না গেলে তোকে জ্যান্ত ফেলে দেব মজা কুয়োয়…
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সত্যিই আমাদের শিয়রের জানালায় দুটি ছায়ামূর্তি দেখা গেল। তারা গরাদ কাটছিল। আমি টর্চ জ্বালাতেই লুকিয়ে পড়ল তারা। আমি স্বামীকে ডেকে তুললাম। কিছু চেঁচামেচি হৈ-চৈ হল। চোর অবশ্য ধরা পড়ল না।
স্বামী ফের ঘুমোলেন। আমার ঘুম এল না। অন্ধকারে পিসিমার থানের আভাস দেখতে পাচ্ছিলাম।
তোর এত মোষের মতো ঘুম কেন রে মাগী? গয়নাগুলো পাহারা দিতে পারিস না? খুব স্বামীর সঙ্গে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকা! মর, মর, মর… তোদের লাজলজ্জা নেই? অত দেয়ালা কিসের রে? বেশ্যার মতো সেজেগুজে থাকিস সন্ধেবেলা, বরকে ভোলাতে, তোর কেন শোথ হয় না? বাত হয় না? ক্ষয়কাশ হয় না? এ বাড়ির ছেলেকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছিস! থুঃ… থু… থুঃ… অমন ভালবাসার মুখে থুঃ .. থু… থুঃ ..
সারা রাত পিসিমা ঘরের চারদিকে ঘুরলেন আর অবিরল থুঃ… থুঃ… থুঃ… থুঃ… থুঃ… করে যেতে লাগলেন। আজ উনি উত্তেজিত। আজ ওঁর বড় রাগ। আর একটু হলেই ওঁর অত সাধের গয়না চোরে নিয়ে যেত।
নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল খুব। পুরোনো বাড়ি, নীচের তলায় থাকি, ঘরে একশ ভরির ওপর নিরেট সোনাদানা। বাড়িতে নতুন ঠাকুর চাকর বহাল হয়েছে। আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
পরদিনই আমি সিন্দুক আনালাম। পিসিমার গয়না রইল তার মধ্যে। চাবি রইল আমার শক্ত হেফাজতে। আমাদের টাকা হচ্ছে। এক একদিন দোকানে বিক্রির পরিমাণ বিশ হাজারও ছাড়িয়ে যায়। সিন্দুক সেদিক দিয়েও আমাদের নিশ্চিন্ত করল।
বিয়ের চার বছর পর একটু পাপ ছুঁয়ে গেল কি আমাকে। একটু কাঁপিয়ে দিয়ে গেল কি আমার ভিত ভূমিকম্পে? ঝড় এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল কি আমার খোলা জানালা দরজার ঘর?
এবার সেই কথা বলি। আমার স্বামীকে প্রায়ই কলকাতা যেতে হয়, দিল্লি বা বোম্বাইও যেতে হয়, যেতে হয় বেনারস, কাঞ্চিপুরম। আমাদের দোকান আরও বড় হয়েছে। পাঁচজন কর্মচারী খাটে। আমি এক বগ্গা এক ধরনের মাল আনা পছন্দ করি না। স্বামীকে বলি, আসল দোকান থেকে জিনিস আনা দরকার। নইলে আমরা পুরোনো আর একঘেয়ে হয়ে যাব খদ্দেরের কাছে। দামও পড়বে বেশি। আর পাইকাররাও আমাদের ঠকায়।