বিয়ের কয়েকদিন বাদে ওঁর মুড বুঝে আমি একদিন বললাম, আচ্ছা, আমি এ বাড়িতে কার অন্ন খাচ্ছি তা কেন বুঝতে পারি না বলুন তো!
উনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, তার মানে?
আমি এ বাড়িতে কার অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছি তা জানতে ইচ্ছে করে।
ওটা কোনও প্রশ্ন হল? তুমি আমি সবাই একই অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছি।
আমি যে বুঝতে পারছি না।
বুঝবার দরকার কি? ভাত তো জুটছে, তা হলেই হল।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। ওটা কাজের কথা নয়। কেউ একজন তত জোগান দিচ্ছেন। তিনি কে?
উনি এ সময়ে বিরক্ত হতে পারতেন, আমাকে ধমকও দিতে পারতেন। আমি অন্তত সেরকমই প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু উনি রাগ করলেন না। গভীর চিন্তিত মুখ করে বললেন, কেন, তুমি কি জানো না?
আমি খুব ভয়ে ভয়ে মৃদুস্বরে বললাম, আপনি রাগ করবেন না। যা জানি সেটা একটুও সম্মানজনক নয়। আমি শুনেছি, সোনা আর জমি বেচে এ সংসার চলে।
উনি হ্যাঁ না কিছু বললেন না। বিকেলের চা খাচ্ছিলেন একতলার জানালার ধারে বসে। জানালার বাইরে কাঁচা ড্রেন, তার ওপাশে নোনা ধরা দেওয়াল। ঘরে পিলপিল করছে মশা, ড্রেনের একটা বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে। ভারী বিষণ্ণ আর ভার একটা বিকেল।
উনি খুব ধীরে ধীরে চা খেয়ে কাপটা পুরোনো আমলের কাঠের গোল টেবিলটার ওপর রেখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, কথাটা ঠিক। তুমি আরও কিছু বলতে চাও বোধহয়?
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ওঁর মুখটা গম্ভীর, গলাটা যেন আরও গম্ভীর। কিন্তু ভয় পেতে শাশুড়িই বারণ করেছেন। আমি বললাম, ঘরের সোনাও লক্ষ্মী, জমিও লক্ষ্মী। শুনেছি এসব বেচে খাওয়া খুব খারাপ।
উনি গম্ভীর বটে, কিন্তু অসহায়ও। সেটা ওঁর পরের কথায় প্রকাশ পেল। উনি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, কী করা যাবে তা তো বুঝতে পারছি না।
আমি একটু সাহস করে বললাম, দেখুন, সোনাদানা অফুরন্ত নেই। জমিও বোধহয় শেষ হয়ে এল। আমাদের কি সাবধান হওয়া উচিত নয়?
উনি আমার দিকে অকপটে চেয়ে থেকে বললেন, আমাদের বলতে? তুমি কি তোমার আর আমার কথাই ভাবছ?
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, তা কেন? এ বাড়ির সকলে মিলেই তো আমরা।
উনি বিমর্ষ মুখে বললেন, বিয়েতেও আমাদের অনেক খরচ হয়ে গেছে। আচ্ছা, হঠাৎ কথাটা তুললে কেন বলো তো!
আমি গরিব ঘরের মেয়ে, সেটা তো জানেন! গরিবদের বড্ড কষ্ট। আপনাদের যদি গরিব হয়ে যেতে হয় তা হলে কষ্টটা সহ্য হবে না। আপনারা তো আদরে মানুষ।
তোমরা গরিব বলে এ বাড়ির কেউ কখনও তোমাকে অপমান করেনি তো!
তা করেনি। কিন্তু গরিব বলে মনে মনে আমার সবসময় সঙ্কোচ হয়।
উনি মৃদুস্বরে বললেন, সঙ্কোচের কিছু নেই। তোমরা তো আর নিজেদের অবস্থা গোপন করনি। আমরাও জেনেশুনেই কাজটা করেছি। তোমার কি মনে হয় আমি একটা অপদার্থ?
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, তা কেন? আপনাকে আমি কতটা শ্রদ্ধা করি তা আপনি হয়তো জানেন না। আপনি অপদার্থ হবেন কেন? তা নয়। আপনি ইচ্ছে করলেই রোজগার করতে পারেন তো!
কিভাবে করব বলো তো! আমি মোটে বি.এ পাশ। এতে বড়জোর একটা কেরানিগিরি জুটতে পারে। তার বেশি কিছুই নয়, এবং সেটাও পাওয়া শক্ত। চাকরি করব বলে তো কখনও ভাবিনি।
চাকরি না করলেই কি নয়? ব্যবসাও তো করা যায়।
ব্যবসা! সে তো দোকানদারি। ওটা পারব না।
আমি ওঁর ভাব দেখে হেসে ফেললাম। বললাম, আচ্ছা, এখন ওসব কথা থাক। আপনি চা খেয়ে বেরোতে যাচ্ছিলেন, আমি আটকে রেখেছি আপনাকে। আপনি ঘুরে আসুন, পরে দুজনে মিলে কিছু একটা পরামর্শ করব। আপনি তাতে রাগ করবেন না তো!
উনি জবাব দিলেন না, চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেলেন। অন্যমনস্ক ছিলেন বলেই বোধহয় আমার কথাটা ভাল করে কানে যায়নি।
মফস্বল শহরগুলোয় থাকা ভারী একঘেয়ে। বেড়ানোর জায়গা নেই, সিনেমা হল ছাড়া আর কোনও আমোদমোদ নেই, তাও পুরোনো বস্তাপচা ছবি। একমাত্র এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে কুটকচালি করা। এ বাড়িতে তাও বারণ। যার তার বাড়িতে যাওয়া পরিবারের মর্যাদার পক্ষে হানিকর। সুতরাং সন্ধের পর ভারী বিষণ্ণ আর একা লাগে। কাঁদতে ইচ্ছে করে। মা-বাবার জন্য মন কেমন করা তো আছেই। ছেলেরা তবু আড্ডা মারতে বা তাসটাস খেলতে যায়, কিন্তু মেয়েদের সে উপায়ও তো নেই। আমার শাশুড়ি সন্ধের পর জপতপ করেন। জা আমাকে সহ্য করতে পারেন না। সুতরাং আমি বড্ড একলা।
বাড়ির যে অংশটায় আমরা থাকি তা দক্ষিণ দিকে। একতলা, দোতলা এবং তিনতলা মিলিয়ে ছ-সাতটা ঘর আমাদের ভাগে। উত্তর ভাগে আরও সাত-আটখানা ঘরে থাকে শরিকরা। আমাদের ভাগে লোকসংখ্যা কম। ভাসুরের ছেলেপুলে নেই, শুধু দেবা-দেবী। তাঁরা দোতলায় দুখান ঘর নিয়ে থাকেন। দুখানা ঘর নিয়ে থাকেন জ্যাঠাশ্বশুর। একতলায় একখানা ঘরে আমরা। সামনের দিকে দুখানা ঘর শ্বশুর-শাশুড়ির। তিনতলায় থাকেন আমার পিসশাশুড়ি। তিনখানা বড় বড় ঘর তাঁর কিসে লাগে কে জানে! আমি পারতপক্ষে ওঁর কাছে যাই না। গেলেই এমনভাবে তাকান যে, রক্ত জল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে কোনও কারণ ঘটলে তিনতলা থেকে উনি এমন চেঁচান যে, গোটা বাড়ির লোক শুনতে পায়। গলার এত জোর আমি আর দেখিনি। বিয়ের পর আমাকে উনি একদিন ওঁর ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খুব ভারী একছড়া খাঁটি সোনার হার পরিয়ে দিয়েছিলেন গলায়। এ পর্যন্ত বেশ ভালই ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু তারপর আমাকে এমন অনেক ঠেস-দেওয়া কথা বলেন, এত অপমানজনক যে চোখে জল এসেছিল। তেজী মেয়ে হলে গলা থেকে হার খুলে ফেরত দিত। আমি তা পারিনি। উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যা বললেন, তা হল, কাঙালী বাড়ি থেকে মেয়ে আনাতে উনি মোটেই খুশি হননি। নিশ্চয়ই এ বাড়ির ঠাটবাট দেখে আমার মাথা ঘুরে গেছে। আমার শাশুড়ির মুণ্ডুপাত করলেন কিছুক্ষণ, আমার মতো হা-ঘরে বাড়ির মেয়ে পছন্দ করে আনার মূলে নাকি উনিই, তা হবে না-ই বা কেন, শাশুড়িও নাকি হা-ঘরে বাড়িরই মেয়ে। ইত্যাদি।