ধুতরো বাটা খাইয়েছি একথা কে আপনাকে বলল?
উনি যেন এ প্রশ্নে একটু ভয় খেয়ে বললেন, রাগ কোরো না। আমি তো আর থানা-পুলিশ করতে যাচ্ছি না। এমনকি তোমার ভাসুরকেও কখনও বলিনি। এই যে মুখ বন্ধ করে আছি এর কি কোনও দাম নেই? বলো!
কী বলব তা ভেবে পেলাম না। বেশির ভাগ মানুষেরই অভ্যাস হল, যেখানে বলার কথা কিছু নেই সেখানেও অকারণে কথা বলে যায়, প্রয়োজন থাক বা না থাক। ওই অভ্যাসটা আমার নেই। আমি অকারণে অযথা কথা বলি না। প্রয়োজন না থাকলে একদমই নয়। তাই এখনও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বা ওঁর সন্দেহ নিরসনের জন্য আমি বৃথা চেষ্টা করলাম না। আমি জানি, যাই বলি না কেন উনি বিশ্বাস করবেন না।
উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, চলে গেছ নাকি?
না আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
তুমি কিছুই তো বললে না! কী ধরে নেব?
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
উনি আর একবার আমার দিকে চাইলেন। চোখ জ্বলছে। বললেন, তার মানে তুমি কিছুই দেবে না আমাদের? কিছুই না?
আমি নীরবে চেয়ে রইলাম। দেখলাম, ওঁর চোখে রাগের আগুনটা দপ করে জ্বলে উঠল। উনি এমনিতেই দজ্জাল ছিলেন। অনেকদিন ধরে নিজের উগ্রতাকে ছিপি বন্ধ করে রেখেছেন। এখন কাসুন্দির বোতলের ছিপি যেমন উগ্র ঝাঁঝে ছিটকে যায় তেমনি ওঁর ছিপিটাও উড়ে গেছে।
উনি দাঁত কড়মড় করে বললেন, রাক্ষুসী! সব খাবি? সব নিজে ভোগ করবি? অনেক ভয় পেয়ে থেকেছি, অনেক আসকারা দিয়েছি! আর নয়…
বলতে বলতে নিজের অচল ব্যাধিগ্রস্ত শরীরটাকে কেবলমাত্র রাগের ইন্ধনে উনি বিছানা থেকে ছিটকে তুলে দিলেন। তারপর এলো চুল উড়িয়ে, আঁচল খসিয়ে প্রেতিনীর মতো ধেয়ে এলেন আমার দিকে। দু’হাতের আঙুল গলা টিপে ধরার জন্য উদ্যত।
আমি অবাক হয়ে লোভ, লালসা, হিংসে, বিদ্বেষ সব কিছুর একটা মানুষী রূপ চেয়ে দেখছিলাম। সরতেও পারিনি। উনি প্রায় বাঘিনীর মতো এসে পড়লেন আমার ওপর, আজ তোকে শেষ করব… শেষ করব… তারপর মরি তো মরব… আগে তোকে শেষ করব…
কে যেন আমার কানে কানে বলল, তুইও ধর না গলাটা চেপে।
আমার জায়ের গায়ে যেন এক অসুরের শক্তি ভর করেছিল। উনি আমার গলা সাঁড়াশির মতো চেপে ধরলেন।
পিসিমা আমার কানের কাছে বলতে লাগলেন, ওরে মরবি নাকি? তা মর। দুজনেই মর। ওর গলাটাও চেপে ধর না কেন। হাত দুটো তোল না মাগী। এঃ, নুলোর মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখ!
আমি শ্বাস নেওয়ার প্রাণপণ আর জায়ের হাত ছাড়ানোর জন্য টানা হ্যাঁচড়া করতে করতেও বললাম, না পিসিমা।
এই ‘না পিসিমা’ কথাটা আমার জা শুনতে পেলেন। তাঁর হাত শ্লথ হয়ে গেল। বড় বড় অস্বাভাবিক চোখে আমার দিকে চেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ডাইনী! তুই ভূতপ্রেত ডাকছিস! ভূতপ্রেত ডাকছিস! তুই সব পারিস। সব পারিস! তোকে মেরে তবে মরব আমি, তোকে মেরে…
কানে কানে পিসিমা বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়! ও যে সর্বনাশ করবে তোর। গলাটা টিপে ধর! ধর বলছি!
আমার দুচোখ দিয়ে ধারা বইছে। আমি নিশ্চেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকি।
পিসিমা বলতে লাগলেন, এই সুযোগ আর পাবি না। কেউ কোথাও নেই। গলা টিপে মাগীকে শেষ করে দে। কেউ টের পাবে না। কাকপক্ষীও জানতে পারবে না।
জা তড়পালেন বটে কিন্তু আর পারলেন না। আমার গলা টিপে ধরার জন্য হাত তুলে এগিয়ে আসছেন, হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে।
পিসিমা বললেন, তুই বুঝতে পারছিস না, ও বেঁচে থাকলে তোর বড় বিপদ। একদিন তোকে ঘুমের মধ্যে গিয়ে মেরে আসবে। এইবেলা শত্রু নিকেশ কর।
আমার জা আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না। তার আগেই অচল শরীরের সব শক্তি নিঃশেষিত হয়ে পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে। পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
আমি ধীর পায়ে নীচে নেমে এলাম।
রাত্রে আমি আমার স্বামীকে বললাম, আমার আর একটা দোকান করার ইচ্ছে।
স্বামী অবাক হয়ে বলেন, আবার দোকান! একটা নিয়ে বেসামাল হয়ে আছি। এক এক দিন এখন দশ পনেরো হাজার টাকার বিক্রি, চোখের পাতা ফেলার সময় পাই না। আবার দোকান করলে দেখবে কে?
আমি আবদারের গলায় বললাম, এখানে রেডিও টেপরেকর্ডার এসব জিনিসের ভাল দোকান নেই। খবর পেয়েছি জগু সাহার দোকানটা বিক্রি হবে। একটু দেখুন না খোঁজ নিয়ে।
স্বামী আমার দিকে চেয়ে ছিলেন। হঠাৎ বললেন, তোমার গলায় ও কিসের দাগ? ইস, এ যে দাগড়া দাগড়া লাল হয়ে আছে! ছড়েও গেছে খানিকটা!
আমি মাথা নত করে বললাম, আমাকে যদি বিন্দুমাত্র স্নেহ করেন তাহলে আর জানতে চাইবেন না। পুরুষমানুষের সবকিছু জানতে নেই।
উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কিছু গোপন করতে চাও? বেশ।
চোখের জল সামাল দিতে আমার কিছু সময় লাগল। তারপর বললাম, একটা কথা বলতে চাই।
কী কথা?
মানুষ তখনই পুরোপুরি সুখী হতে পারে যখন তার কানে অন্য মানুষের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ আসে না।
স্বামী অবাক হয়ে বললেন, এ তো নীতিবাক্যের মতো শোনাচ্ছে।
তবু বড় সত্যি। তাই না, বলুন!
কী বলতে চাও বলো না! আমি তো তোমার কথা কখনও ফেলি না।
আপনি আমার কাছে পুরুষশ্রেষ্ঠ।
উনি মৃদু হেসে বললেন, ওইসব বলে বলে তুমি আমার মাথাটা একদিন খাবে। শেষমেশ আমি নিজেই হয়তো নিজের সম্পর্কে ভাবতে শুরু করব।
আপনি বুঝবেন না, আমি কোথা থেকে শক্তি পাই, কেন অমঙ্গলের মধ্যেও মঙ্গল আমার হাত ধরে থাকে।