শাশুড়ি বললেন, তা হলে তোমার দোকানে যাওয়ার দরকারটা কী? চিরকাল শালগ্রাম শিলা হয়ে থেকেছ, এখনও তাই থাকে না। সংসার তো চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
উনি রেগে উঠে বললেন, কেন, আমি কি পারি না?
কোনও দোকানদার যদি তোমাকে অপমান করে তা হলে তুমি কি আর তার দোকানে যাও?
দোকানদার অপমান করবে? আমাকে? কার ঘাড়ে কটা মাথা?
তা হলেই বোঝো, দোকানদারের অপমান খদ্দের হজম করে না। তার আরও দশটা দোকান আছে।
আমারও আরও দশটা খদ্দের আছে।
না, তা নেই। একজন খদ্দের অপমান হয়ে গেলে ঠকে গেলে, আরও দশটা খদ্দেরও কেটে পড়ে। তুমি কি ভাবে দোকানদারি মানেই হল কম দামে কিনে বেশি দামে বেচা? তা হলে তো ভালই ছিল।
শ্বশুর গুম হয়ে রইলেন। কিন্তু পরদিন থেকে তিনি দোকানে যেতেন বটে, কিন্তু আর কোনও ঝামেলা করতেন না। বরং বুড়ো বয়সে তিনি নতুন করে জিনিসের দাম ফেলার হিসেব শিখতে লাগলেন মন দিয়ে।
একদিন বললেন, দেখো বউমা, লোকে দরাদরি করতে ভালবাসে। দু টাকা দাম কমাতে পারলে মনে করে মস্ত জিত হল। তোমার ফিক্সড প্রাইসের দোকানে সেই সুখ নেই। আমি বলি কী, তুমি বাঁধা দরের সিস্টেমটা তুলে দাও। দাম একটু বাড়িয়ে রাখো, দরাদরি করে খদ্দের ওটুকু কমিয়ে নেবে আর খোশমেজাজে জিনিস নিয়ে যাবে।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, সেটা তো ঠিক কথা।
উনি খুশি হয়ে বললেন, তা হলে কাল থেকে তাই করব তো?
করুন না। তবে মুশকিল হল, অনেকেই জেনে গেছে এ দোকানে বাঁধা দরে জিনিস বিক্রি হয়। কাজেই কেউ দর করবে না, দু-একজন নতুন খদ্দের ছাড়া।
উনি ভাবিত হয়ে বললেন, তাই তো! তা হলে তো সমস্যা দেখা দেবে।
উনি নিজে থেকেই পরিকল্পনাটা ত্যাগ করলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর থেকে শ্বশুর সকাল বিকেল দু বেলাই দোকানে যেতে লাগলেন। বলতে নেই, উনি চমৎকার চালাতে লাগলেন ব্যবসা। আমাকে মাঝে মাঝেই বলতে লাগলেন, না, এ কাজে বেশ থ্রিল আছে। সারাটা দিন বেশ কেটে যায়, পাঁচটা লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়, নিত্যনতুন মানুষ দেখি। নাঃ, সত্যিই একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
আমার জা ওপর থেকে নামেন না। বাতের ব্যথা, ব্লাডপ্রেশারে শয্যাশায়ী। সম্ভবত ঘটনার বছরখানেক পরেও উনি আমার সম্পর্কে ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আমি তাই ওপরে যেতাম না। ভাসুর আমার জায়ের খাবার বয়ে নিয়ে দিয়ে আসতেন। আমার সঙ্গে ওঁর দেখাই হয় না।
একদিন সন্ধেবেলায় উনি আমাকে ডেকে পাঠালেন।
গেলাম। উনি আমার দিকে না-তাকিয়ে দেয়ালের দিকে চোখ ফিরিয়ে রাখলেন। বললেন, অপরাধ নিও না। একটা কথা বলতে চাই। না বলে উপায় নেই।
আমি ঘরে ঢুকিনি। দরজার চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পাছে উনি ভয় খান। বললাম, বলুন।
আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। আমার স্বামীর হাতে পয়সা নেই। ঘরে সোনাদানাও নেই যে বেচব। আমাদের আর চলছে না।
আমাকে কী করতে বলেন?
তোমাকে কী আর বলব? আমাকে বাণ মেরে অকেজো করে রেখেছ। মারোনি, সে তোমার দয়া। কিন্তু এখন আর মরতে আমার ভয় নেই। বিছানায় শুয়ে বেঁচে থাকাও যা, মরাও তাই।
আমি বাণ মারতে জানি না।
উনি আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ভাতে মারোনি, সেও তোমার দয়া। তন্ত্রমন্ত্র জানো, মারণ উচাটন বশীকরণ জানো, তোমার অসাধ্য কিছু নেই। শুনেছি, নিজের শ্বশুরকে দোকানের কর্মচারী বানিয়ে রেখেছ।
ভুল শুনেছেন।
আমি তর্ক করতে চাই না। তুমি ইচ্ছে করলে আরও অনেক কিছু করতে পারো। সংসার ছারখার করতে পারো। সবই মানছি। কিন্তু ভয় পেলে আমার চলবে না। তাই বলছি।
একটু খুলে বলুন দিদি।
বলতে ভয়ও করছে। তবু জানতে চাইছি, সেই গয়নার কি সবটাই বেচে দিয়েছ?
একথা কেন?
মস্ত দোকান করেছ শুনলাম। অনেক টাকার ব্যাপার।
দোকান আমার গয়না বেচে করেছি। আমি আর কারও গয়নার কথা জানি না।
আমি তো ভাগ চাই না। রাগ করছ কেন? আমি ভিক্ষে চাইছি। যদি কিছু অবশিষ্ট থেকে থাকে তা হলে দয়া করে আমাকে কিছু দাও।
আমি জানি ভয়ের চেয়েও লোভের জোর বেশি। লোভ মানুষকে ভয় টপকাতে শেখায়, জয় করতে শেখায় না। আমার জা আমাকে যমের মতো ভয় পান, কিন্তু লোভ সামলাতে পারছেন না।
উনি চোখের জল মুছছেন বারবার। বললেন, যা করলে তার বিচার ভগবান করবেন। কিন্তু আমাদেরও কিছু পাওনা ছিল, এটা ভুলে যেও না। আমার স্বামী খুব লজ্জার মধ্যে আছেন। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না তোমাকে। ওঁর বড় অভাব। আমার চিকিৎসা অবধি বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
ওঁর বয়স তত বেশি নয়। উনি ইচ্ছে করলেই তো রোজগার করতে পারেন।
রোজগার করবে? কিভাবে করবে?
আগে ইচ্ছেটা তো হোক।
উনি হঠাৎ আমার দিকে এক পলক তাকালেন। মরিয়া হয়েই বোধহয়। সেই চোখে আমি এক পলকে গভীর ঘৃণা, বিতৃষ্ণা আর ভয় এক সঙ্গে দেখতে পেলাম।
উনি মুখটা আবার ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, উনি লেখাপড়া বিশেষ শেখেননি। ম্যাট্রিক পাশকে কে চাকরি দেবে? আমাদের গয়নার বাক্সও নেই যে দোকান দিয়ে বসব। ইচ্ছের কথা বলছ? ওঁর ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। মনমরা হয়ে থাকেন সবসময়ে। কেবল বলেন, ফুচু কেমন দাঁড়িয়ে গেল, কত পয়সা হচ্ছে ওদের, আর আমাদের শুধু কোঁচার পত্তন। তাই বলছি, আজ আমাদের কিছু ভিক্ষে দাও।
উনি কী করতে চান?
কিছু একটা করবেন। কী করবেন তা জানি না। বলে একটু চুপ করে থেকে গলাটা এক পর্দা নামিয়ে বললেন, ধুতরো বাটা খাইয়ে পিসিমাকে মেরেছ, গয়নার বাক্স নিয়েছ, তবু আমি সে কথা কাউকে বলিনি। বিষবিছের মতো চেপে রেখেছি নিজের বুকে। আমার প্রতি তোমার একটু কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত।