এ শহরের পাইকারদের কাছ থেকে মাল কিনলে লাভ বেশি হয় না। কিন্তু কলকাতার বড়বাজার বা মংলাহাট থেকে কিনলে অনেক বেশি লাভ হয়। আমার স্বামীকে সেটা বুঝিয়ে বলে রাজি করালাম। অলস এবং ঘরকুননা লোকটি রাজি হচ্ছিলেন না। প্রথম দুবার আমি সঙ্গে যাই। এরপর উনি একা যেতে লাগলেন।
প্রতিদিন মানুষের রুচি পাল্টায়, এক-এক বছর এক-এক রং বা ডিজাইনের ভীষণ চাহিদা হয়, বুদ্ধি করে ফাটকা খেলতে হয়। আমরা সেসব মাথায় রেখে মাল কিনতাম। লাভ বাড়তে লাগল।
একদিন শ্বশুরমশাই সন্ধের পর অপ্রত্যাশিত দোকানে হানা দিলেন। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় চাদর, হাতে ছড়ি, পায়ে নিউ কাট। চারদিকে তাচ্ছিল্যের চোখে একটু তাকিয়ে দেখলেন। দোকানে তখন খদ্দেরের বেশ ভিড়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিক্রিবাটা দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর চলে গেলেন।
এলেন আবার কয়েকদিন বাদে। আমি বসতে চেয়ার এগিয়ে দিলাম। বসলেনও।
বেশ বিক্রি দেখছি।
আপনাদের আশীর্বাদে হয়।
আমি আশীর্বাদ করিনি তো বউমা। আমি তো অভিশাপই দিই। আমার কোনওটাই ফলে না। পাপী লোক তো।
চুপ করে রইলাম।
উনি বললেন, আমাদের কথা অমান্য করেছ, সেটা ভাল করোনি। কিন্তু তুমি যা করো তা শেষ অবধি ভালই হচ্ছে দেখছি। মাসে কত আয় হচ্ছে?
দু-চার হাজার হবে।
সে তো অনেক টাকা!
ওঁর পৌরুষে এবং আত্মসম্মানে লাগবে বলেই আমি বললাম না যে, পাকিস্তান থেকে ওঁদের জমি আর পুকুর বিক্রির টাকা আজও আসেনি, বিক্রি করার মতো সোনাও আর নেই, তবু সংসার যে চলে যাচ্ছে তা তো ম্যাজিকে নয়। বলার দরকারও ছিল না। উনি সেটা জানেন। জানেন বলেই দোকানটা দেখতে আসেন আজকাল।
ওঁর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসিটা ছিল না। ওঁর চোখের সামনেই দু হাজার টাকায় দুটো বিয়ের বেনারসী বিক্রি হয়ে গেল।
উনি নড়েচড়ে বসে বললেন, আচ্ছা বউমা, ও দুটো বেনারসী থেকে তোমাদের কত থাকল?
আমি লাজুক হাসি হেসে বললাম, বেনারসীর দাম, তার সঙ্গে গাড়িভাড়ার একটা ভগ্নাংশ, দোকানের ভাড়া, বিজলির খরচ, কর্মচারীর মাইনে এসবে এক একটা গড় করে যোগ দিয়ে তবে দাম ফেলতে হয়।
উঃ, সে তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! এত হিসেব করো কী করে? আমরা বরাবর মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়ে দিয়েছি, গুনেও দেখিনি। এটা তো দেখছি ছোটলোকের কাজ!
আমি মৃদুস্বরে বললাম, ও দুটো শাড়ি থেকে আমাদের ছশো ত্রিশ টাকা লাভ হয়েছে।
উনি যেন একটু চমকে গিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, ছশো ত্রিশ! মাত্র দুটো বেনারসীতে!
বিস্ময়টা নিয়ে উনি বেশ চিন্তিত মুখে ফিরে গেলেন।
আরও কয়েকদিন পর উনি একদিন আমাকে ডেকে বললেন, সকালে তোমাকে খুব তাড়াহুড়ো করে দোকানে যেতে হয় দেখেছি। শোনো, সকালে তো আমি ফ্রি থাকি। আমিই গিয়ে ফুচুর সঙ্গে বসবখন।
শুনে আমি ভয় পেলাম। ওঁর জমিদারি মেজাজ। হয়তো খদ্দেরদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবেন না। বললাম, আপনি কেন কষ্ট করবেন? ওখানে আপনাকে মানায় না।
উনি একটু হাসলেন, ভয় পেও না। ব্যাপারটা আমাকে একটু বুঝতে দাও। ভেবে দেখেছি, ভগবান মগজ বলে যে জিনিসটা দিয়েছিলেন সেটা কোনও কাজেই তো লাগালাম না। বুড়ো বয়সে একটু মগজের জড়ত্ব ছাড়ানোর চেষ্টা করে দেখিই না।
আমি আর বাধা দিলাম না। উনি গেলেন। আমার স্বামী ফিরে এসে দুপুরে আমাকে বললেন, কী কাণ্ড! বাবা সব শাড়ির দাম বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছিল। দুজন খদ্দের ভেগে গেছে। বাবাকে পাঠালে কেন? উনি তো খেতে পর্যন্ত এলেন না। বললেন, তুই খেয়ে আয়, তারপর আমি যাব।
উনি জোর করে গেলেন। থাক, বাবাকে আপনি এ নিয়ে কিছু বলবেন না। উনি লাভ বাড়াতে চাইছেন। প্রথম প্রথম ওরকম হয়।
আমি আর আমার স্বামী এ নিয়ে একটু হাসাহাসি করলাম।
আমার স্বামী দোকানে ফিরে যাওয়ার পর শ্বশুর এলেন। অত্যন্ত উত্তেজিত, ঘর্মাক্ত, মুখ চোখ ঝলমল করছে। এসেই বললেন, বউমা, এসব তোমার কর্ম নয়। আমি আজ সাতটা শাড়ি বিক্রি করে এলাম। সব কটা চড়া দামে। একটা শাড়ির কোণে পেনসিলে লেখা ছিল পঞ্চাশ টাকা। কী করলাম জানো? পঞ্চাশের আগে একটা এক বসিয়ে দিলাম। সেই শাড়ি দেড়শ টাকাতেই বিক্রি হয়ে গেল। বুঝলে? বাড়তি একশ টাকা লাভ।
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। দোকানের সুনাম সবে হচ্ছে। খদ্দের যদি শাড়িটা যাচাই করে তা হলে ফিরে এসে হয় ঝগড়া করবে, নয়তো ফেরত দিতে চাইবে। ভবিষ্যতে দোকানের ছায়াও মাড়াবে না। কিন্তু শ্বশুরকে সেটা বোঝানোর সাধ্য কী? উনি নতুন খেলনা পেয়ে শিশুর মতো উৎফুল্ল উত্তেজিত। শাশুড়ির কাছে ফলাও করে দোকানদারির গল্প করতে লাগলেন। নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠল।
শাশুড়ি আড়ালে ডেকে বললেন, তোমার দোকান এবার লাটে উঠবে।
আমি হাসলাম।
উনি বললেন, ভাল চাও তো শ্বশুরের দোকানের নেশা ছোটাও।
আমি বললাম, থাক। সামলে নেব।
পরদিন দুজন খদ্দেরের সঙ্গে শ্বশুরের তুমুল বচসা হয়ে গেল দাম নিয়ে। তারা দুঁদে খদ্দের। বলেছিল, কয়েকদিন আগেই তারা যে শাড়ি সত্তর টাকায় এ দোকান থেকে কিনেছে তা তিন দিনের তফাতে একশ সত্তর হয় কী করে? এ তো চোরের দোকান। শুনে শ্বশুর আস্তিন গুটিয়ে তাদের মারতে উঠলেন। আমার স্বামী মাঝখানে পড়ে ঠেকালেন।
দুপুরে শ্বশুর বাড়িতে এসে তুমুল আস্ফালন করে বললেন, এইজন্যই তো বলি দোকানদারি হল ঘোটলোকেরই কাজ। যেসব লোক আমাদের জুতো বইবার যোগ্যতা রাখে না তারাও এসে চোখ রাঙায়?