ওসব জানি। পাকিস্তানে আরও কিছু জমি আর একটা পুকুর শিগগিরই বিক্রি হয়ে যাবে। ও টাকা এলে আর চিন্তা নেই।
আমি ঘরে চলে এলাম। একটু বাদে আমার স্বামীও এলেন। আমাকে বললেন, ওদের মত হল দোকানটা বিক্রি করে দেওয়া।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, কাল থেকে দোকানে আপনার বসবার দরকার নেই। আমি বসব।
তুমি! বলে তিনি হাঁ করে রইলেন।
আমি ওঁর মুখের দিকে সজল চোখে চেয়ে বললাম, আপনাকে আজ আমার আর একটা কথা বলার আছে। অভয় দিলে বলব।
উনি অবাক হয়ে বলেন, বলো না।
আপনি কি অন্য কোনও মেয়েকে ভালবাসেন?
কী বলছো?
তাঁর নাম কি কমলা?
উনি যেন কুঁকড়ে গেলেন। এত অসহায় দেখাল লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষটিকে! আমি বললাম, শুনুন, সংকোচ করবেন না। যদি কমলাকে আপনার প্রয়োজন হয় তা হলে আপনি ওঁকে বিয়ে করে ঘরে আনুন। আমি সতীন সহ্য করতে পারব।
উনি বিছানায় বসে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেললেন। লজ্জা!
আমি দু চোখে ধারা বিসর্জন করতে করতে বললাম, গোপনে তার কাছে যাওয়ার দরকার নেই। গোপন যেখানে ঘৃণা, লজ্জা, ভয়ে সেইখানেই দুর্বলতা, সেইখানেই পাপ। আপনাকে সে পাপ আমি করতে দিতে পারি না।
উনি অনেকক্ষণ মুখ ঢেকে বসে রইলেন। তারপর বিষণ্ণ, লজ্জাতুর মুখখানা তুলে বললেন, তোমাকে কমলার কথা কে বলল?
সেটা কি খুব জরুরি?
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বিয়ে করার প্রশ্ন ওঠে না। তুমি আসার পর তার কাছে আমি খুব কমই যাই।
শুনুন, অপরাধ নেবেন না। আপনি যাতে ভাল থাকেন আমি তাই চাই। সবচেয়ে বড় কথা, আপনাকে নিয়ে আমি গৌরব করতে চাই। আপনিই তো আমার অহংকার। আপনি কিছু গোপন করবেন না। এটুকু জানবেন, আপনাকে খারাপ ভাববার সাধ্যই আমার নেই।
তুমি আমাকে ঘেন্না করছ না?
একটুও না। আপনি দয়া করে আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন না। নত হবেন না।
উনি বিস্ময়ভরে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, আমার বিশ্বাস হয় না।
কী বিশ্বাস হয় না?
তোমাকে রক্তমাংসের মানুষ বলে।
ওকথা বললে আমার পাপ হয়। তার চেয়েও বড় কথা আপনি নিজেকে সবসময়ে অপরাধী ভাবতে ভাবতে ছোট হয়ে পড়বেন।
উনি আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তা হলে তোমাকে বলি, আমাদের দোকানের কর্মচারী ধীরেন টাকাপয়সা চুরি করে পালিয়েছে বটে, কিন্তু বেনারসীগুলো সে নেয়নি।
কে নিয়েছে? কমলা?
হ্যাঁ, একদিন দোকানে এসে নিয়ে গেল। এখন আর উদ্ধার করা যাবে কি?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। কুড়িটা বেনারসীর এমন কিছু দাম নয়। কমলা এটুকু পেতেই পারে। যদি তাকে বিয়ে করেন তা হলে সে তো আরও অনেক পাবে।
উনি জিব কাটলেন, বিয়ের কথা তুলছ কেন?
তা হলে কী ধরে নেব?
যা হয়েছে তা আর হবে না।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, পুরুষেরা চঞ্চলমতি, বহুগামী হয়। আপনি যদি আবার ও কাজ করেন তা হলেও কিছু মনে করব না। শুধু কথা দিন, আমার কাছে গোপন না থাকে।
উনি মূক বিস্ময়ে শুধু মাথা নাড়লেন। ওঁর চোখে একটা ভয় বা আতঙ্ক দেখা দিল। উনি আমাকে স্বাভাবিক স্ত্রীলোক বলে ভাবতে পারছেন না আর।
কিন্তু আমি জানি আমি খুব সাধারণ স্ত্রীলোক। আমি শুধু এই সংসার থেকে আমার পাওনাটুকুই কুড়িয়ে নিতে চাই আমার আঁচলে। বিরুদ্ধতা থাকবে, অদৃশ্য শত্রু থাকবে, দুর্বিপাক থাকবে, দৈব থাকবে, তার ভিতর দিয়েই তো যেতে হবে। বুদ্ধিভ্রংশ হলে তো চলবে না। আমি যদি কমলাকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে ঝগড়া অশান্তি করতাম তা হলে ওঁকে পেতাম কী করে? বরং আহত পৌরুষ, অপমানিত অহং আরও শক্ত হত। উনি জেদ করে কমলার কাছে আরও যেতেন। জ্বলেপুড়ে আমি খাক হতাম। তার চেয়ে আমি ওঁর দরজা খোলা রাখলাম। উনি ইচ্ছে করলেই অন্য মেয়েমানুষের কাছে যেতে পারবেন। কিন্তু ওঁর আর যাওয়ার ইচ্ছে হবে না।
সেদিন সারারাত বারবার আমার ঘুম ভাঙল, আর আমি শুনতে পেলাম, পিসিমা আমার ঘরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে কেবল বলছেন, মর, মর, মর, মর, মর, মর···বিধবা হ···বিধবা হ···কুড়িকুষ্ঠ হোক···
আমি শ্বশুর ভাসুরদের কথার প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আমি আমা স্বামীকে প্ররোচিত করতে পারলাম। বললাম, শুনুন, দোকানে আপনি না গেলে আমি যাব। সম্মান রাখতে গেলে আগে বাঁচতে হবে।
উনি বললেন, ঠিক আছে। আমিই যাচ্ছি।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনাকে একা দোকানের ভার দিলে আপনি হয়তো অস্বস্তিতে পড়বেন। আমিও থাকব আপনার সঙ্গে।
বাড়ির লোক কী বলবে?
ওঁরা কয়েকদিন বলবেন। তারপর আর বলবেন না। সয়ে নেবেন। দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে ওঁরাও তো দেখছেন। মুখে প্রতিবাদ করলেও দোকান থেকে যদি আমরা লাভ করতে থাকি তা হলে ওঁরা একদিন সমর্থনও করবেন।
তুমি বলছ! তুমি কখনও বোধহয় ভুল বলল না। ঠিক আছে, তাই হবে।
ভাবালুতা আমার নেই। আমার আছে ভয়, আছে উদ্বেগ, আছে বাস্তব জগৎ থেকে যতখানি পারা যায় বেঁচে থাকার খুঁটিগুলি খুঁটে তুলে নেওয়ার চেষ্টা। আমরা দুজনে যখন দোকান আগলে বসতে লাগলাম তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে, ওঠা-পড়ায়, লাভ-লোকসানে আমাদের মধ্যে সত্যিকারের ভালবাসা হল। এল বিশ্বাস, নির্ভরতা, পরম্পরকে আরও শ্রদ্ধা করা।
উনি হিসেব রাখতে হিমসিম খান, স্টকের খোঁজ রাখেন না, ধারে মাল দিয়ে দেন। যতদিন কর্মচারী ছিল ততদিন তার ওপরেই নির্ভর করতেন। তাই মাত্র ক’দিনেই দোকানটার বড় দুর্দশা হয়েছে। হিসেব আমিও রাখতে জানি না, স্টক মেলানো কাকে বলে তাও কি জানতাম? কিন্তু সন্তান-লালনের কিছু না জেনেও একজন মেয়ে যখন প্রথম মা হয় তার কি আটকায়? দোকান ছিল আমার সন্তানের মতো। ওঁকে সেটা বোঝাতে আমার একটু সময় লেগেছিল। আরও একটু সময় লেগেছিল গা থেকে জমিদারির ধুলো ঝেড়ে ফেলে শ্রমিকের মতো পরিশ্রমী করে তুলতে। দোকান লাভ দিতে শুরু করল।