দোকানের পিছনে যে আমার হাত আছে এটা তাঁরা জানতেন। একদিন শাশুড়ি, আমাকে ডেকে বললেন, এঁরা তো সব তোমার ওপর খাপ্পা। কিন্তু আমি বাপু তোমাকে একটুও দোষ দিই না। ফুচু যে নড়াচড়া করছে, শরীরের আর মনের মরচে যে ঝরছে এতেই আমি খুশি। আজ বিকেলে বোধহয় তোমার সঙ্গে তোমার শ্বশুর এ নিয়ে কথা বলবেন। ঘাবড়ে যেও না।
কিন্তু ঘাবড়ে আমি গেলাম। শ্বশুর ভাসুরের সঙ্গে খুব সামান্যই কথা হয়। আমি কি বুঝিয়ে বলতে পারব?
দুপুরবেলাটা খুব আনমনা কাটছিল। একা ঘরে হঠাৎ কার উপস্থিতি টের পেয়ে তাকিয়ে দেখি, ঘরের কোণে সেই থানকাপড়। অস্পষ্ট অবয়ব।
কী রে, এবার? মজা বুঝবি। তোর শ্বশুর রাগী লোক, আজ তোকে জুতোপেটা করবে।
আমি বললাম, করুক।
শোন, যা বলছি তা ঠিক ঠিক করলে বেঁচে যাবি।
কী করব?
তোর শ্বশুরের একটা গোপন খবর আছে। সেটা জানিস?
না তো!
ওর একটা রাখা মেয়েমানুষ আছে। তার নাম চামেলী। খালধারে থাকে। চামেলীর পিছনে অনেক খরচা করেছে। টাকাপয়সা সোনাদানা। শ্বশুর চোখ রাঙালে তুইও বলবি, চামেলীর কথা জানি। তা হলেই ঘাবড়ে যাবে।
আমি জানি এসব বনেদি পরিবারে কিছু বদ অভ্যাস থাকে। শ্বশুরের রক্ষিতা থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি চুপ করে রইলাম।
পিসিমা বললেন, কথাটা মানলি না বুঝি?
আমি ওসব বলতে পারব না।
তা পারবি কেন? আরও শুনবি? তোর বরেরও আছে, তার নাম কমলা। ভাবছিস তোকে নিয়ে রসে মজে থাকে? মোটেই নয়। তোর রূপেরই বা কী ছিরি, গুণেরই বা কী। ভাবছিস মাথাটা খেয়ে বসে আছিস? কচুপোড়া। ফাঁক পেলেই কমলার কাছে যায়।
আমি শিহরিত হলাম। দু চোখ জলে ভরে উঠল।
হঠাৎ শুনি পিসিমা কাঁদছেন, এ বাড়ির পুরুষরা কি কেউ কম? সব বদমাশ, সব কটা হাড়ে হারামজাদা। ওই তোর জ্যাঠাশ্বশুর, ভাসুর কেউ কম যায়? প্রত্যেকটার একটা-দুটো করে মাগী আছে, ঘরের বউ তো ডাল-ভাত। তাতে কি ওদের হয়? নিজেরা ফুর্তি করেছে, আর আমাকে গয়নার বাক্স খেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখেছে ঘরে। বোকা বলে ভুলেও থেকেছি। রামখেলাওন বলে একটা চাকর ছিল। তখন আমার সোমত্থ বয়স। শরীরে জোয়ার-ভাটা ডাক দিচ্ছে। রামখেলাওন ছিল সা-জোয়ান মানুষ। ধকধক করছে ডাকাতের মতো শরীর। শুনছিস?
বলবেন না পিসিমা, পায়ে পড়ি।
ইস, বড় সতী এসেছেন! কেন শুনবি না? ভাল করে শোন। শেষে সেই রামখেলাওনকে একদিন ইশারা করলাম। সে নিশুতরাতে এল। বিধবার সব ধর্ম ভাসিয়ে দিয়ে সেদিন ইচ্ছেমতো পাপ করার বাসনা ছিল। আগুন জ্বলছিল শরীরে। বাঘিনীর মতো বসে আছি খাপ পেতে। ঠিক সেইসময় বোকা লোকটা শেষ সিঁড়িতে পা হড়কে আছাড় খেল। তারপর সে কী কাণ্ড! তোর জ্যাঠাশ্বশুর আর শ্বশুর মিলে কী মার মারল লোকটাকে। মেরে তাড়িয়ে দিল। শুদ্ধাচারী বালবিধবা বোন উপোসী রয়ে গেল। আর ওরা পরদিনই কানে আতর গুঁজে গেল রাখা মেয়েমানুষের কাছে। শুনছিস?
শুনছি পিসিমা।
কাঁদছিস বুঝি? খুব কাঁদ, প্রাণভরে কাঁদ। তোর বুকে লঙ্কাবাটার জ্বলুনি হোক। যদি বাঁচতে চাস আজই শ্বশুরের মুখের ওপর বলবি, আমি চামেলীর কথা জানি। বুঝেছিস?
পারব না পিসিমা।
তা হলে মর, মর, মর, মর, এখনই মর। তোর কুড়িকুষ্ঠ হোক। তোর বাপ মা মরুক, ভাই বোন মরুক, বেটা-বেটি মরুক।
চোখের জলে আমি ভাসছিলাম। বুকে পাষাণভার।
জ্বলছিস তো! এবার ওদেরও মুখে নুড়ো জ্বেলে দে। রগড়ে দে। সংসারে আগুন লাগা। শ্বশুর, ভাসুর, বর সব কটাকে মুখে জুততা ঘষে দে। মরুক, ওলাউঠা হয়ে মরুক, গলিত কুষ্ঠ হোক। শুনছিস তো!
জবাব দিতে পারলাম না।
আমার মতো জ্বলুনি যেদিন হবে সেদিন বুঝবি।
সন্ধেবেলা নীচের বৈঠকখানায় সবাই বসলেন। শাশুড়ি এসে ডাকলেন আমাকে, এসো বউমা। ডাকছে। মাথা ঠাণ্ডা রেখো।
বুকটা বড় ভার ছিল সেদিন।
শ্বশুরমশাই গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ছোটো বউমা, বোসো। কথা আছে। বেশ গুরুতর কথা।
আমি বসলাম না। দরজার পাশটিতে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
শ্বশুরমশাই বললেন, এইসব দোকান-টোকান দিয়ে আমাদের যে বংশের বড় অপমান হয়ে যাচ্ছে। এটা তো মোটেই সম্মানজনক ব্যাপার হয়নি। আমাদের বংশের ছেলে সামান্য দোকানদার হবে এটা কেমন কথা?
আমি চুপ করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
জ্যাঠাশ্বশুর বললেন, আমরা এও শুনেছি বিয়ের সময়ে তোমাকে যে সব গয়না যৌতুক দেওয়া হয়েছিল সেগুলি বেচেই দোকান করা হয়েছে। গয়নাগুলো হল তোমার গুরুজনদের দেওয়া আশীর্বাদ। তুমি আশীর্বাদের মূল্য দাও না? গয়না বিক্রি করায় যে তাঁদের অপমান হল!
ভাসুর বললেন, দোকানই বা দিতে হবে কেন? অন্য সব ব্যবসা তো আছে। দোকানে ক’পয়সাই বা আয়? এই তো শুনলাম, এক মাসেই বহু টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে। কর্মচারী চুরি করে পালিয়েছে।
শ্বশুরমশাই বললেন, তোমার বক্তব্যও আমরা শুনতে চাই। যুগ পাল্টে গেছে। আগে বাড়ির বউ-ঝিদের মতামতকে মূল্য দেওয়া হত না। আজকাল কাদের মুখ ফুটেছে। তুমি বলো।
আমি কোনও কথাই বললাম না। ওঁরা এখন উত্তপ্ত হয়ে আছেন। আমার কানও কথাই ওঁদের গ্রহণযোগ্য মনে হবে না।
শ্বশুরমশাই বললেন, রসময়ীর (পিসিমার নাম) গয়নাগুলো চুরি যাওয়াতে আমরা একটু মুশকিলে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু এসব কেটে যাবে।
আমি বুঝলাম না, এ পরিবারের আর্থিক সংকট কিভাবে কাটবে বলে উনি মনে করেন। খুব মৃদুস্বরে এবার আমি বললাম, গত মাসে চালের আর তেলের দাম বেড়েছে। বাজারের বরাদ্দ কমেছে। মুদির দোকানে দু মাসের ধার জমে আছে।