দোকানদারিই করব?
দোষ কী? আপদ্ধর্ম হিসেবে সবই করা যায়।
টাকা কোত্থেকে আসবে?
বিয়েতে আমি অনেক গয়না পেয়েছি। আপনাদের বাড়ি থেকেই পাওয়া। পিসিমা একটা হার দিয়েছিলেন, ভরি দশেক হবে। একজোড়া বালা আছে, পাঁচ ভরির কম নয়। হীরের আংটি আছে।
বলো কী? এসব বেচব?
না আপনি বেচবেন কেন? আমি বেচব। টাকা আপনাকে দেব।
তোমার কী থাকবে?
আপনি থাকবেন।
সেইদিন সন্ধেবেলা পিসিমা হাজির হলেন।
আমার আশীর্বাদী হারছরা বেচে দিলি?
হ্যাঁ পিসিমা।
কোন সাহসে? কুড়িকুষ্ঠ হয়ে পচে গলে মরবি যে।
মরতে চাই না বলেই তো বেচেছি।
বড় বউয়ের কী দশা করেছিলাম মনে আছে?
আছে।
তোরও ব্যবস্থা করব নাকি?
না পিসিমা। ক্ষমা করুন। আমাদের উপায় নেই। থাকলে কেউ সোনা বিক্রি করে?
তুই ছোটলোক বাড়ির মেয়ে, সব পারিস। বুড়ি ছুঁয়ে আছিস বলে তেমন কিছু করছি না।
বুড়ি ছুঁয়ে আছি? বুড়ি ছোঁয়া কাকে বলে?
ওরে, আমি বালবিধবা না হলে দেখতি বরকে আমিও কত ভক্তি করতুম। কিন্তু সেই অলপ্পেয়েটা তো বিয়ের সময়েই আধবুড়ো ছিল। তার ওপর কাশের রোগ। টক করে মরেই গেল।
ওরে, আমি বালবিধবা না হলে দেখতি বরকে আমিও কত ভক্তি করতুম। কিন্তু সেই অলপ্পেয়েটা তো বিয়ের সময়েই আধবুড়ো ছিল। তার ওপর কাশের রোগ। টক করে মরেই গেল।
বেঁচে থাকলে কী করতেন?
পিসিমা লজ্জা-লজ্জা গলায় বললেন, কত কী করতাম! অনেক সোহাগ করতাম, তোর মতো। সব সময়ে চোখে চোখে রাখতাম।
আমি হাসলাম।
উনি বললেন, আমার বিয়ের সময় সোনার ভরি ছিল কুড়ি টাকার মতো। এখন কত হয়েছে রে?
হাজার টাকা।
বলিস কী? তুই তো রাক্ষুসী! অত টাকা তোর সইবে? সোনার অভিশাপ আছে, তা জানিস? ও দোকান উচ্ছন্নে যাবে। এ বাড়ির ছেলেকে ব্যবসাদার বানালি? নরকে তোকে ময়লার বালতিতে চুবিয়ে রাখবে। তোর মরা ছেলে হবে, দেখিস।
আমার বুক ভীষণ কেঁপে উঠল। মাত্র কয়েক হাজার টাকা মূলধন নিয়ে আমার স্বামী দোকান দিলেন। দোকান দিতেই কত খরচ হয়ে গেল আসবাবপত্র কেনা, সাজানো গোছানোর খরচ সামলে মাল কেনার পয়সাতেই টান পড়ে গেল। কিছু ধার-দেনা করে কোনওরকমে দোকান সাজিয়ে বসলেন তিনি। কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই, হিসেবে ভুল করেন, বড়বাড়ির ছেলে হয়ে নানান ধরনের খদ্দেরের সঙ্গে বিনীতভাবে কথা বলতে তাঁর মর্যাদায় লাগে। তার ওপর চেনা লোক বা বন্ধুবান্ধবরা জিনিস নিয়ে দাম বাকি ফেলে রেখে যায়। একজন কর্মচারী রাখা হয়েছিল, সে এক মাস বাদে টাকা আর দশ-বারোখানা বেনারসী চরি করে পালিয়ে গেল।
উনি ভীষণ হতাশ হয়ে আমাকে বললেন, এ রকমভাবে চলবে না। পারছি। না।
আমি কিন্তু ভেঙে পড়লাম না। তেমন দুর্বিপাক হলে, মস্ত ক্ষতি হলে, পিসিমার একশ ভরির ওপর সোনার গয়না তো আমার কাছে আছে। দরকার হলে তাতে হাত দেব। তাতে বাঁচি মরি ক্ষতি নেই।
আমি বললাম, ব্যবসা মানেই ওঠা-পড়া। আপনি কিছু ভাববেন না। আমি তো আপনার পিছনে আছি।
তোমার সাধের গয়নাগুলো গেল।
আপনিই আমার সবচেয়ে বড় গয়না।
আমার স্বামী গম্ভীর মানুষ। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার এত বয়স অবধি ঠিক এভাবে আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমার ওপর তোমার এত ভালবাসা দেখে অবাক হই। কেন এই অপদার্থকে এত ভালবাসো বলো তো! আমার যে বড় আত্মগ্লানি হয়। আমি আজ বুঝতে পারছি, আমি কোনও কাজেরই নই, কোনও যোগ্যতাই নেই আমার।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, আপনি তবলা বাজানো তো ছেড়েই দিয়েছেন দেখছি। ওগুলোয় ধুলো পড়ছিল। আমি মুছে-টুছে রেখেছি। একটু তবলা বাজান না, মনটা ভাল হবে। আমি তানপুরা ধরছি।
এ প্রস্তাবে উনি খুব খুশি হলেন। অনেকক্ষণ তবলা বাজানোর পর ওঁর মনটা ভাল হয়ে গেল। বললেন, বেশ একটা মুষ্টিযোগ বের কঁরেছ তো!
ওঁকে ঘিরেই আমার জগৎ। আমি যে ওঁকে ভালবাসি তা ওঁর রূপের জন্যও নয়, গুণের জন্যও নয়। ভাল না বেসে থাকতে পারি না বলে বাসি। এই ভালবাসাটুকুই আমার প্রাণের পিদিমকে জ্বেলে রাখে। এসব আমি কাউকে বলতে পারব না। ওঁকেও নয়। আমার শ্বাসে-প্রশ্বাসে মিশে থাকে ওঁর চিন্তা, ওঁরই ধ্যান। আবার উনি আমার দিকে বেশি ঢলে পড়লেও আমি শঙ্কিত হয়ে উঠি। উনি যদি স্ত্রৈণ হয়ে পড়েন তা হলে পুরুষের ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হবেন। স্ত্রৈণ পুরুষকে কেউ সম্মান করে না, মূল্য দেয় না, তাদের ব্যক্তিত্বও থাকে না। এক-একদিন উনি দোকানে যেতে চান না, বলেন, আজ দোকান থাক। আজ তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে। আমি অমনি উঠে পড়ে বলি, তা হলে আমাকে গিয়ে দোকানে বসতে হবে।
এইভাবে নরমে, গরমে, শাসনে, সোহাগে মানুষটাকে নিরন্তর আমি ব্যস্ত রাখি। এঁরা বংশগতভাবে অলস, আয়েসি। একটু রাশ আলগা দিলেই নেতিয়ে পড়েন।
দোকান দেওয়ার ঘটনাটা এ বাড়ির কেউ ভাল চোখে দেখেননি। বিশেষ করে দুই শ্বশুর এবং ভাসুর। ছোটখাটো অশান্তি লেগে যেত প্রায়ই। শ্বশুরমশাই আমার স্বামীকে ডেকে বললেন, দোকান করা কোনও ভদ্রলোকের কাজ? তুই তো বংশের নাম ডুবিয়ে দিলি! ছিঃ ছি, পাঁচজনকে মুখ দেখাতে পারি না।
ভাসুরও খুব বিরক্ত। খেতে বসে প্রায়ই শোনাতেন, ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়াই কঠিন হয়েছে। বন্ধুরা টিটকিরি দিচ্ছে।
জ্যাঠাশ্বশুর খুব সরব নন, তবে মাঝে মাঝে বলেন, এ হল বৈশ্যবৃত্তি। পাতিত্য।