আজ আমি পরী হয়ে উড়ে যাব।
কোথায় যাবে?
উড়ে বেড়াব। তুমি এরোপ্লেনে চড়েছ?
না তো!
কেমন লাগে গো?
জানি না।
ভয় করে?
আমার তো খুব ভয় করবে। তুমি শুয়ে পড়ো।
এখন শোবো না। এমন জ্যোৎস্না! বলে শ্রীময়ী আবার গান গাইতে লাগল, যত পারো পয়সা বাঁচাও…
আমি চাপা স্বরে বললাম, এই শ্রীময়ী!
কী বলছ?
তুমি আর কোনও গান জানো না?
জানি।
আর কী গান জানো?
জানি। কিন্তু মনে পড়ছে না।
এটা কিন্তু বিচ্ছিরি গান। একটা ভাল গান গাও না! চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে গানটা জানো?
না তো!
আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।
আমি শিখব না।
এ গানটা আর গেও না। এটা বিচ্ছিরি গান।
আমার এটাই আসে।
ওরা বুঝি তোমাকে সব সময়ে পয়সা বাঁচাতে বলে?
পয়সা কত দামি জিনিস।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। বাথরুমে চোখে মুখে জল দিতে দিতে মনে হল, না, এ জীবনে আর বিয়ে করব না। কিছুতেই না। বিয়ের চেয়ে মরণ ভাল। মরে যদি ভূত হতে পারি তাহলে চলে যাব সেই উপত্যকায়, পাহাড়ে, জঙ্গলে, নদীর ধারে ধারে এলোচুলে খালি পায়ে গান গাইতে গাইতে…
৩. সোমলতা
॥ সোমলতা ॥
শুঁটকি রাঁধছিস বুঝি? বেশ চনমনে গন্ধ!
না তো! আমরা শুঁটকি খাই না।
এঃ, নবাবনন্দিনী এলেন! শুটকি খান না! কেন, খেলেই তো পারিস। বেশ লঙ্কাবাটা, পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে মাখা-মাখো ঝাল গরগরে হবে। খাস না কেন?
গন্ধ লাগে
ইঃ, গন্ধ লাগে! শুটকির গন্ধ তবে কোথা থেকে পাচ্ছি?
পাশের বাড়িতে হচ্ছে বোধহয়।
ওরা খেতে পারলে তোর খেতে দোষ কী? অত ফুটুনি কিসের?
গন্ধটা কি আপনার ভাল লাগে?
আমি বিধবা না? ভাল লাগে বলতে আছে? পাপ হয়। তুই কী রাঁধছিস?
মাছ।
কী মাছ?
ফুলকপি দিয়ে কৈ।
কী ফোড়ন দিলি?
আমরা মাছে ফোড়ন দিই না।
তুই ছাই রান্না জানিস। পাঁচ ফোড়ন দিতে হয়।
আচ্ছা।
আর কাঁচা তেল দে, একমুঠো চিনি দে, একটু সোডা ফেলে দে। দেখবি কেমন স্বাদ হয়।
আচ্ছা।
যত পারিস মাছ টাছ খেয়ে নে। আর তো দু মাস।
আমার বুক কেঁপে উঠল। রান্নাঘরে খোলা দরজার ওপাশে পিসিমা দাঁড়িয়ে। একটু অন্ধকারমতো জায়গা। শুধু থানটা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে বললাম, ওকথা কেন বললেন?
তুই যে বিধবা হবি।
আমার চোখ জ্বালা করে উঠল, বুকে ঢেউ ছিল। বললাম, পিসিমা! কেন এমন হবে?
হবে না কেন? শুধু আমিই জ্বলব, তুই জ্বলবি না?
আমি কী করেছি পিসিমা? কোন পাপ?
আমিই কোন পাপ করেছিলাম? তোর কি পেটে বাচ্চা এসেছে?
জানি না তো!
এলে সেটাও মরবে। বাচ্চার দরকার নেই। স্বামীর সঙ্গে শুবি না। আলাদা থাকবি।
আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। থানকাপড়টা অদৃশ্য হয়ে গেল। এত আনমনা ছিলাম যে মাছের ঝোলটা শুকিয়ে পুড়ে ঝামা হয়ে গেল। কেউ খেতে পারল না।
রাতে আমি আমার স্বামীকে বললাম, আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?
উনি অবাক হয়ে বললেন, ক দিন আগেও একথা জিজ্ঞেস করেছ। কেন বলো তো!
বলুন না।
না ভূত টুত কিছু নেই। তোমার কি ভূতের ভয় আছে?
কী জানি। হয়তো আছে।
তুমি তো শক্ত মেয়ে, তবে এই অদ্ভুত ভয়টা কেন?
ঠিক ভয় নয়। আপনাকে বোঝাতে পারব না।
উনি আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করে বললেন, কোনও ভয় নেই।
সেই রাতে আমরা খুব সুন্দরভাবে মিলিত হলাম। তারপর স্বামী ঘুমোলেন। আমি দুশ্চিন্তা নিয়ে ছটফট করতে লাগলাম।
উনি কখন আসবেন তার ঠিক ছিল না। তবে রাতে রান্নার সময়েই বেশি আসতেন। ভুল পরামর্শ দিতেন। মাছে বা মাংসে চুলের দলা, ছাই বা মরা টিকটিকি পাওয়া যেত প্রায়ই। বিছানায় প্রচণ্ড লাল পিঁপড়ের উৎপাত হওয়ায় কাড়তে গিয়ে দেখি, বিছানায় চিনির দানা ছড়ানো।
একদিন বললাম, এসব কী হচ্ছে পিসিমা?
হবে না কেন রে? আমি সংসারে কোন সুখটা পেয়েছি?
শুনেছি, আপনি এ সংসারের মাথায় ছিলেন!
তোর মাথা। গয়নার বাক্সখানা ছিল বলে খাতির করত। ওই জোরেই তো বাপের বাড়িতে ঠাঁই হল। নইলে ঝ্যাঁটা মেরে তাড়াত।
তাহলে আপনি এখন কী চান পিসিমা?
এখন চাই তোর স্বামী মরুক, তোর সন্তান না হোক, তুই বিধ্বা হ। তারপর তুইও মর। সবাই মরুক। দুনিয়াটা ছারখার হয়ে যাক। ঘরে ঘরে আগুন লাগুক।
মা গো!
কেন, খারাপ লাগছে শুনতে? মর মাগী, খারাপ কী রে? আমার মতো হলে বুঝবি চারদিকটা শ্মশান হয়ে না গেলে সুখ নেই।
দু মাসের মাথায় আমার স্বামী মারা গেলেন না।
পিসিমা একদিন আড়াল থেকে বললেন, কেমন লাগে রে?
আমি বললাম, কী কেমন লাগে?
পিসিমা লজ্জা মেশানো গলায় বলেন, আহা, ন্যাকা কোথাকার! বোঝে না যেন! ওই যে ওসব, যখন বরের সঙ্গে ওসব হয় টয়।
ছিঃ পিসিমা।
ইস্, একেবারে লজ্জাবতী লতা! কেন জানতে চাইলে দোষ হয় বুঝি? সাতে বিয়ে, বারোতে বিধবা। আমার কি আর তখন বোঝবার বয়স ছিল? যখন শরীর ডাকাডাকি শুরু করল তখন মাথার চুল মুড়িয়ে কেটে পাথরের থালায় একবেলা বিস্বাদ আলোচালের ভাত খাই। একাদশী করি। আমার জ্বালা তুই বুঝবি না। বল না কেমন লাগে।
ভাল।
দূর মাগী। ভাল তো সবাই জানে। খুলে বল না।
আমার লজ্জা করে পিসিমা।
তাহলে মর। মর মর মর মর।.এখনই মর।
ও মা গো! ওভাবে বলতে আছে?
একশবার বলব।
আমাদের অবস্থা পড়তির দিকে। ধীরে ধীরে পয়সার টান পড়ছে। খরচ বাড়ছে। আমার স্বামী একদিন বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এখন বোধহয় আমাদের কিছু করা উচিত। কি করব বলো তো!
ব্যবসা করুন না।