বকুক না। তোর নীতীশ তোকে কত গয়না দেবে।
প্রীতি রাগ করে বলে, হ্যাঁ দেবে। কত দেবে জানা আছে! মাকে গিয়ে যে কী বলব!
কানের একটা রিং-এর জন্য এই রাত্রিটা, এর এত জ্যোৎস্না, এত ঐশ্বর্য সব ব্যর্থ হয়ে গেল প্রীতির কাছে। মুখ গোমড়া করে বসে রইল পাশে। প্রীতির মতো মেয়েদের জন্য বোধহয় এ সব নয়। প্রীতির জন্য ঘুপচির ঘর, বশংবদ স্বামী, ভরা ভর্তি সংসার।
আর আমার জন্য? আমি তা জানি না।
কিছুক্ষণ পর আমার প্রীতির জন্য একটু মায়া হল। মুখটা বড্ড ভার করে বসে আছে। বললাম, শোন, তুই ভেবে নিতে পারিস না যে, দুলটা হারায়নি?
কী করে ভাবব? ওরকম ভাবা যায় নাকি?
কেন যাবে না? দুলটা যদি রাস্তায় পড়ে গিয়ে থাকে বা আর কোথাও, তাহলে সেখানেই পড়ে আছে। তাই না?
সেই তো!
তাহলে এক জায়গায় তো আছেই সেটা! তুই মনে কর তোর রিংটা ওখানে তুই-ই রেখে এসেছিস।
দূর! কী যে সব বলিস পাগলের মতো! কোনও মানে হয় না।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে একটু বকুনি শুনে শুয়ে পড়লাম। গভীর রাত অবধি ঘুম এল না। মাতাল-মাতাল লাগছিল নিজেকে। আমার ছোট কৌটোয় আজ অনেক আনন্দ ভরা হয়েছে। ঢাকনা বন্ধ হচ্ছে না। আমি ঘুমোবো কী করে? মা যেমন কখনও ঠোঙার চিনি কৌটোয় ঢালতে গিয়ে বিপদে পড়ে যায়, কৌটো উপচে যাচ্ছে, ঠোঙার চিনি তখনও ফুরোয়নি। কৌটো ঠুকে ঠুকে জায়গা করে ফের চিনির শেষটুকু সাবধানে ঢালে, তবু ফুরোয় না। কী জ্বালাতন তখন! আমার অবিকল সেই অবস্থা।
প্রীতি তার কানের একটা রিং হারিয়ে এসেছে। আর আমি! আমি তো আমার গোটা অস্তিত্বই ফেলে এসেছি ওই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত জনহীন উপত্যকায়। টের পাচ্ছি, আমি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি সেখানে। এলোচুল শ্লথ পা, গলায় একটু গানের গুনগুন, চারদিকে সোনার গুঁড়ো ঝরিয়ে দিচ্ছে মস্ত চাঁদ। নদীর জলে নুড়ি পাথরে ঢেউ ভাঙার মৃদু শব্দ। কী গহিন, কী গভীর স্বপ্নের মতো সুন্দর।
আমি যদি মরি ঠিক ভূত হব। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জন উপত্যকায় পাহাড়ে, জঙ্গলে, বালিয়াড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়াব। ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠব। বৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজব। কিছুতেই মেয়ে হয়ে জন্মাব না আর।
হঠাৎ শুনতে পেলাম, এই নিশুতরাতে চাটুজ্জে বাড়ির পাগল বউটা বেসুরো গলায় গান গাইছে, যত পারো পয়সা বাঁচাও, যত পারো পয়সা বাঁচাও… কচুপোড়া কাঁচকলা খাও, ডেঁড়েমুশে গতর খাটাও… যত পারো পয়সা বাঁচাও, যত পারো পয়সা বাঁচাও…
বিছানায় থাকতে পারলাম না। ওই বউটার জন্য আমার বড় কষ্ট হয়। আমার ঘরের জানালার সোজাসুজি বউটার ঘর। কয়েক হাত মাত্র তফাত। চার বছর আগে বিয়ে হয়ে শ্রীময়ী যখন এল তখনই সবাই বলাবলি করেছিল, বউটার এবার হাড়ে কালি লাগবে। চাটুজ্জেরা কৃপণ এবং সেটা প্রায় বংশগত। দাদু কৃপণ ছিল, বাপ কৃপণ, ছেলে কৃপণ। চারু চাটুজ্জে উকিল। মক্কেলরা শুধু পয়সা দিয়ে পার পায় না, কার বাড়িতে কলাটা, কার বাড়িতে মুলোটা হয় সেসব খবর রাখে চারু চাটুজ্জে। দরকার হলে বাড়ি গিয়ে হানা দিয়ে নিয়ে আসে। চারু চাটুজ্জের রোজগার ভাল। ছেলে সুমিতও সরকারি অফিসার। ফ্যানশুদ্ধ ভাত, তরকারির খোসা, আটার ভুশি কিছু ফেলে না ওরা, সব খায়। বউটা ওই অসহ্য কৃপণতা সহ্য করতে পারেনি। পাগল হল, ছেলে হতে গিয়ে। পেটে বড়সড় বাচ্চা ছিল, নরমাল ডেলিভারি হচ্ছিল না। দিশি ধাই তখন ভয় পেয়ে বলেছিল ডাক্তার ডাকতে। সিজারিয়ান করাতে। শেষ অবধি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু হাসপাতালে জায়গা ছিল না। এ শহরে বেশ কয়েকটা নার্সিং হোম আছে। কিন্তু চাটুজ্জেরা সেসব জায়গায় নেয়নি। টানাহ্যাঁচড়ার ধকলে শ্রীময়ী মরতে বসেছিল হাসপাতালের বারান্দায়। অবশেষে অল্পবয়সী একজন গায়নোকলজিস্ট সকালে রাউন্ডে এসে মেয়েটির অবস্থা দেখে নিজেই সিজারিয়ান ডেলিভারি করায় হাসপাতালে। বাচ্চাটা বাঁচেনি। শ্রীময়ী বেঁচে গেল। কিন্তু শ্বশুর আর স্বামীর কৃপণতায় সে এমন ধাক্কা খেয়েছিল আর সেইসঙ্গে সন্তানের শোক মিলে মাথাটা বিগড়ে গেল। এখন ওই গান গায়, হাসে, কাঁদে। আবার ঘরের কাজও করে।
আমি জানালাটা খুলে চাটুজ্জে বাড়ির দিকে চেয়ে রইলাম। ওপাশেও জানালা খোলা। শ্রীময়ী এলোচুলে এই ঠাণ্ডায় খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল শ্রীময়ী। মামারা প্রচুর খরচ করে তার বিয়েটা দিয়ে দেয়। বছর দুই হল শ্রীময়ীর মা মারা গেছে। ওর এখন বাপের বাড়ি বলতেও কিছু নেই। মেয়েটা জ্বলছে, পুড়ছে, মরছে।
আমি মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে বলি, এই শ্রীময়ী, তুমি ও বাড়িটায় আগুন লাগাতে পারো না? চারদিকে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দাও। পুড়ে মরুক সবাই।
মা শুনতে পেয়ে একদিন আমাকে বকেছিল। আমার ওপর চাটুজ্জেদের খুব রাগ। তাতে বয়েই গেল। শ্রীময়ী না লাগালে আমিই একদিন গিয়ে আগুন লাগিয়ে আসব।
আমি আস্তে করে ডাকলাম, এই শ্রীময়ী!
শ্রীময়ী গান থামাল। তারপর একটু চুপ থেকে বলল, কী বলছ?
ঘুমোওনি কেন? এত রাতে কেউ গান গায়?
শ্রীময়ী বলল, আজ কেমন জ্যোৎস্না!
জ্যোৎস্না তোমার ভাল লাগে?
নাঃ। আমার কিছু ভাল লাগে না। কান্না পায়।
যাও, শুয়ে পড়ো। ঘুমোও।