গানে গানে, গল্পে, ঠাট্টায় অর্ধেক পথ পেরিয়ে এলাম আমরা। শহরে পৌঁছতে রাত দশটা হয়ে যাবে, তারপর যে-যার বাড়ি ফেরা। কিন্তু সব লক্ষ্যেরই অনিশ্চয়তা থাকে। বন্দনা দিদিমণি যখন ঘড়ি দেখে শিখা দিদিমণিকে বললেন, “আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাব, ঠিক তখনই লরিতে একটা হেঁচকি উঠতে লাগল।
লরির হেঁচকি তোলা দেখেও আমরা হাসাহাসি করতে লাগলাম।
শোভনাদি বিরক্ত হয়ে বললেন, উঃ, তোমাদের হাসির চোটে অস্থির হয়ে গেলাম। লরিটা এরকম করছে কেন? ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করো তো!
জিজ্ঞেস করতে হল না। লরি রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার ক্লিনার নেমে বনেট খুলে আলো জ্বেলে কী যেন দেখতে লাগল।
মাধুরীদি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ড্রাইভার?
ড্রাইভার জবাব দিল, টানছে না। তেলে ময়লা আসছে।
যাবে তো।
যাবে। ঠিক করে নিচ্ছি।
দেরি হবে না তো?
না না, পাঁচ মিনিট লাগবে। বসুন।
পাঁচ মিনিট গড়িয়ে পনেরো মিনিট। তারপর আধঘন্টা।
উদ্বিগ্ন দিদিমণিরা গলা বাড়িয়ে বললেন, কী হয়েছে বলবে তো! এতগুলো মেয়ে, আমাদের একটা রেসপনসিবিলিটি আছে। চলবে?
ড্রাইভার একটু অনিশ্চয়তার গলায় বলে, দেখছি দিদিমণি। সাকশনে গড়বড় করছে।
শোভনাদি রেগে গিয়ে বললেন, তোমরা যে কেন এত দায়িত্বহীন! একটা খারাপ লরি নিয়ে ট্রিপ দিলে? এখন কী হবে? কতটা পথ এখনও বাকি!
মেশিনের ব্যাপার দিদিমণি, কিছু কি বলা যায় আগে থেকে। গত সপ্তাহে ওভারহল করানো হয়েছে।
কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল, লরি বেশ ভালরকম গণ্ডগোলে পড়েছে। মেয়েদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। দিদিমণিরা রাগারাগি করতে লাগলেন।
ইন্দিরাদি বললেন, লরি যদি না চলে তাহলেও আমাদের তো ফিরতেই হবে। ড্রাইভার, তুমি অন্য কোনও লরি থামাও।
ক্লিনার ছেলেটা সেই চেষ্টাও করল। ছুটির দিন এবং বেশি রাতে খুব কম ট্রাকই যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা থামল। সেটা চায়ের বাক্সে বোঝাই। ট্রাকের ড্রাইভার নেমে এসে আমাদের ড্রাইভারকে খানিকক্ষণ সাহায্য করে ফের ট্রাক চালিয়ে চলে গেল। আর দুটো ট্রাক থামল না। একটা প্রাইভেট গাড়ি থামল। কিন্তু তাতে চারটে মাতাল। একজন মাতাল বলল, এত মেয়েছেলে কোথায় চালান যাচ্ছে ভাই? রাতের অন্ধকারে আবু ধাবি পাচার হচ্ছে নাকি?
আর একজন অল্প মাতাল তাকে ধমক দিয়ে বলল, যাঃ, সব ভদ্রলোকের মেয়ে দেখছিস না! পিকনিক পাটি।
তিন নম্বর মাতাল বলল, আরে ড্রাইভার সাহেব, ট্যাঙ্কের মুখ খুলে একটা পাঁইট ঢেলে দাও, লরি উড়ে যাবে।
মাতালরা দাঁড়াল না। তাদের ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।
ঘণ্টা খানেক বাদে ড্রাইভার লরিতে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
স্টার্টারের শব্দ হুড়ম হুড়ম করে খানিকক্ষণ আমাদের ভরসা দিল মাত্র। লরি নড়ল না।
ইন্দিরাদি আর্তনাদ করে উঠলেন, দশটা যে এখানেই বেজে গেল! এখন কী হবে?
ড্রাইভার খুব লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বলল, ব্যাটারিটা ডাউন আছে।
শোভনা দিদিমণি বললেন, তাহলে কী হবে?
একটু ঠেলে দিলেই চলবে।
ঠেলবে কে?
দিদিমণিরা কি একটু হাত লাগাবেন? বেশি দরকার নেই। একটু ঠেললেই হবে।
শুনে আমরা হৈ-হৈ করে উঠলাম। কেন ঠেলতে পারব না? আমরা কি অবলা? দুপুরে আজ মাংস খাইনি? ঝুপ ঝুপ করে নেমে পড়তে লাগলাম আমরা। দিদিমণিরা নানারকম আপত্তির শব্দ করতে লাগলেন, এই সাবধান! লরি হঠাৎ স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করলে কী হবে? লরি ঠেলা কি মেয়েদের কাজ?
কী জগদ্দল ভারী লরিটা! আমাদের ঠেলায় প্রথমে একটুও নড়ল না।
শিখাদি ওপর থেকে বললেন, দাঁড়াও, আমরাও নামছি। আর শোননা, সবাই মিলে একসঙ্গে ঠেলতে হবে। অত হেসো না তোমরা। হাসলে গায়ে জোর থাকে না।
শুনে আমরা আরও হাসতে লাগলাম।
দিদিমণিরা নেমে এলেন। ইন্দিরাদি বললেন, কুলিদের দেখোনি? কেমন হেঁইও হেঁইও করে রেল লাইনের স্লিপার লাগায়? দাঁড়াও, সবাই মিলে ওরকম কিছু করতে হবে।
এই বলে তিনি “খরবায়ু বয় বেগে” গানটার একটা লাইন ধরে ফেললেন, আমি কষে ধরি হাল, তুমি তুলে ধরে পাল, হেঁই মারো মারো টান, হেঁইও… হেঁইও… সবাই মিলে একসঙ্গে বলো হেঁইও…
বলব কী, হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছে।
শুক্লা বলল, আমরা তত টানছি না দিদিমণি, ঠেলছি।
ওই হল।
হাসলে সত্যিই গায়ের জোর থাকে না। আমরা এত হাসছি যে, লরিটা আমাদের ঠেলা টেরই পাচ্ছে না।
শেষ অবধি অবশ্য সকলের হাসি থামল। ঠেলার চোটে লরি একটু একটু এগোতে লাগল। স্টার্টারের ধাক্কায় চমকে চমকে উঠতে লাগল। ভু রু র রু ত… ভু র র র রু ত… তারপর হঠাৎ আমাদের সবাইকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে ঘড়ঘড় করে স্টার্ট নিয়ে ফেলল। আমরা তুমুল হর্ষধ্বনি করে উঠলাম।
লরি ফের জঙ্গলের রাস্তা ধরে ছুটতে লাগল। লরির কানায় বেসামাল বসে আমার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাচ্ছি কেন?
প্রীতি কখন আমার পাশে এসে বসেছে কে জানে। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, এই বসন, শোন, আমার বাঁ কানের রিংটা কোথায় খুলে পড়ল বল তো!
কী করে বলব?
হুকটা একটু লুজ ছিল। লরি ঠেলার সময় পড়ে গেছে বোধহয়। কী হবে এখন?
আমি বললাম, অত ভাবছিস কেন? আজকে এমন বনভোজন, এমন জ্যোৎস্না, তোর রিংটাকে এই জ্যোৎস্নার কাছে উৎসর্গ করে দে।
তুই ভীষণ অদ্ভুত আছিস! কী হবে এখন! মা যে খুব বকবে!