আচ্ছা, তুই কি দাদাকে কখনও মুখ ভেঙিয়েছিলি? বা আওয়াজ দিসনি তো!
কেন বল তো!
দাদার যেন একটু রাগ-রাগ ভাব দেখলাম। আমি ভাবলাম, এই রে, বসন হয়তো মুখটুখ ভেঙিয়েছে।
আমার বুকটা পাথর হয়ে গেল হঠাৎ। রেগে গেছে? রাগবে কেন? একটা মেয়ে ভাব করতে চাইলে এমন কী দোষ?
সুমিতা বলল, আমি অবশ্য বলেছি, বসন ভীষণ ভাল মেয়ে। লেখাপড়া, গান বাজনায় সব দিকে চৌখস। স্বভাবও শান্ত। কক্ষনো কোনও অসভ্যতা করে না।
পরদিন থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে অমলেশদা আর যেত না। বাড়ির সামনে মস্ত মাঠ। সেটা ঘুরে অনেক দূর দিয়ে যেত।
আমার জগৎ-সংসার যেন চুরমার হয়ে গেল এই অপমানে। বয়ঃসন্ধির প্রথম রহস্যের ঘেরাটোপ যখন আমাকে ঘিরে ধরেছে, যখন আমার কল্পনার রাজ্যে হাজার রঙের আলোর খেলা, তখনই হঠাৎ এই নির্মম অপমান যেন আমার উদ্ভিন্ন নারীত্বকেই ধিক্কার দিল। ভেঙে পড়ল আমার চারদিককার চেনা পৃথিবী। যেন বৈধব্যের দীর্ঘ বিষণ্ণতা ধীরে ধীরে উঠে এল পাতালপুরীর অন্ধকার থেকে।
অন্য মেয়ে হলে এ রকম হত না। এ বয়স তো উড়ে উড়ে বেড়ানোরই বয়স। চঞ্চল, মতিচ্ছন্ন, হাল্কা চলন হয় বয়ঃসন্ধিতে। তখন কাকে বাছব তা ঠিক করতেই হিমসিম খেতে হয়। অনেকের মনোযোগ পেতে ভাল লাগে। কিন্তু আমি তো অন্য মেয়ে নই, আমি বসন। আমি এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা নিয়েই জন্মেছি।
যদি কেউ আজও জিজ্ঞেস করে, তুমি কি অমলেশের প্রেমে পড়েছিলে? আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারব না, হ্যাঁ। কারণ, সেটা সত্যি কথা বলা হবে না। তার সঙ্গে আমার জীবনে একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি, চোখাচোখি অবধি না। অমলেশদা দেখতে সুন্দর নয়, স্বাস্থ্যবান নয়, স্মার্ট নয়, শুধু গুড বয়। মেয়েরা শুধুমাত্র গুড বয়ের প্রেমে কমই পড়ে। আমি শুধু ভাব করতে চেয়েছিলাম। কেন জানি না। কারও সঙ্গে ভাব করার একটা ইচ্ছে যখনই হয়েছিল তখন ওই মানুষটার কথাই আমার মনে হয়েছিল।
লোকটা আমার চিঠির জবাব দিল না। পথ বদল করল। রাগ করল আমার ওপর। আমার ওই বয়সে পুরুষ জাতটার ওপর বিতৃষ্ণা জাগিয়ে দিতে ওইটুকুই ছিল যথেষ্ট।
অমলেশদা স্কলারশিপ পেয়ে চলে গেল কলকাতায়। কিছুদিন পর বিদেশে কোথায় যেন। অমলেশদাদের ভাঙা ঘর পাকা হল। দোতলা উঠল। হতদরিদ্র পরিবারে দেখা দিল কিছু সচ্ছলতা। সুমিতা, অমিতা স্ট্যান্ড না করলেও টপাটপ ভাল রেজাল্ট করে স্কুলের গণ্ডি ডিঙোল। অলকেশ এবার পরীক্ষা দেবে। সবাই জানে সেও ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পাবেই। ওদের পরিবারের সঙ্গে এখনও আমাদের বেশ ঘনিষ্ঠতা। আমার আর অমলেশদার মধ্যে কী হয়েছিল কেউ জানে না। আসলে কিছুই হয়নি এমন, যা চোখে পড়ার মতো।
অথচ আমার জীবনটাই পাল্টে দিল সেই নীরব, ঘটনাহীন ঘটনা।
নিঃসঙ্গতার হাত ধরে আমি জ্যোৎস্নায় হেঁটে হেঁটে অনেকটা চলে গেলাম। একা থাকতে আজকাল আমার বেশ লাগে। এই যে একটু বিষণ্ণতা, একটু মন খারাপ, অতীতের নানা অপমানের স্মৃতিতে একটু ভার হয়ে থাকা বুক, চাপা অভিমান, সামান্য হিংসের হুল— এসবই যেন আমার বেঁচে থাকার ঝালমুন। নইলে বড় আলুনি লাগত।
শীতের নদী বালিয়াড়ির মস্ত আঁচল বিছিয়ে রেখেছে। ফটফট করছে জ্যোৎস্না। এত আলো যে, ছুঁচ পড়লেও কুড়িয়ে নেওয়া যায়। নদীর বাঁকের মুখে আমি এসে দাঁড়ালাম। ওদিকে একটা নির্জন পাহাড়। স্তব্ধ, মৌন, স্থির। পায়ের কাছ দিয়ে নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। জলের মধ্যে নুড়ি পাথর অবধি দেখা যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। আর চারদিককার জনহীন খাঁ খাঁ শূন্যতার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হল, এই যে আমি এত একা, আমার জন্য যে পৃথিবীতে কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই, আমাকে কেউ যে ভালবাসে না, এটাই আমার পক্ষে ভাল। খুব ভাল।
শোভনা দিদিমণির গলার স্বর বিপন্ন মানুষের আর্তনাদের মতো কানে এল, বসন! বসন! কোথায় গেলে তুমি, সবাই লরিতে উঠে পড়েছে! শিগগির এসো।
জ্যোৎস্না ও নির্জনতার কাছে, রূপকথার রাজ্যে আমার একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস রেখে ফিরে এলাম।
দিদিমণিরা খুব বকলেন, বড্ড ইররেসপনসিবল মেয়ে তুমি! কত রাত হয়েছে জানো! একজনের জন্য সকলের কত দেরি হয়ে গেল! তোমরা আজকালকার মেয়েরা কী যে হয়ে যাচ্ছ দিনকে দিন!
একা থাকতে আমার বেশ লাগে, আবার দঙ্গলেও খারাপ লাগে না। হাসি, খুনসুটি, গল্প করতে করতে একা-আমিকে ভুলেই যাই। আমি যেন দুটো মানুষ। হাঁচোড় পাঁচোড় করে শাড়ি সামলে উঁচু লরিতে উঠতে খুব হাসাহাসি হল। শতরঞ্জিতে বসলেন আমাদের সাতজন দিদিমণি, ডেগ কড়াই ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে মেয়েরা। লরির ডালায় বসলাম আটদশজন। সামনের দিকে কয়েকজন দাঁড়িয়ে রইল। বেশ ঠাসাঠাসিই হয়ে গেল। ডালায় বসতে দিদিমণিরা বারণ করায় কয়েকজন নেমে ওল্টানো ডেগ কড়াই আর বালতির ওপর বসে পড়ল। কড়াই আর বালতির হাতল থাকায় সেগুলো উপুড় করলে খাপে খাপে বসে না। লরির ঝাঁকুনিতে ঢকঢক করে নড়তে লাগল। আর তা নিয়ে হাসির ধুম।
খানিকক্ষণ হাসাহাসির পর আমরা আবার গান ধরলাম। লরি শহরের দিকে এগোচ্ছে। আমরা জ্যোৎস্নায় প্লাবিত এক অপার্থিব উপত্যকা ছেড়ে চলেছি অপরিসর ঘরের দিকে, ঘুপচির দিকে। মানুষ যে কেন ঘরবাড়ি বানাতে শিখল! সেই আদ্যিকালে পাহাড়ে, গুহায়, গাছের তলায় থাকত মানুষ। বেশ ছিল সেটা। বহু জন্ম আগে আমিও হয়ত ছিলাম এক গুহা-মানবী। পাথর ছুঁড়ে শিকার করতাম, আগুনে ঝলসে খেয়ে নিতাম মাংস, পাহাড়-জঙ্গলে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতাম। বন্ধনহীন জীবন।