বাবুন ভুল করে ধামা তুলতেই মুরগির ছানাগুলো কুককুক করে ডাকতে ডাকতে উল্টোপাল্টা দৌড় লাগাল ঊর্ধ্বশ্বাসে। কিন্তু বন্ধ ঘর থেকে পালানোর পথ না পেয়ে দেয়ালে দরজার গ্যাস সিলিন্ডারে ধাক্কা খেয়ে ছটফটিয়ে ঘুরছে, একটাকে ধরে ফেলেছিল দয়ী। মস্ত ধারালো বঁটিতে গলাটা চোখের পলকে ছিন্ন করে দিল সে। টিপে ধরে রইল নলি, যাতে খুব বেশি রক্ত না পড়ে। তবু পড়ল। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ছড়িয়ে পড়ল সাদা মেঝেয়।
বাবুনের মুখ সাদা হয়ে গেছে দৃশ্যটা দেখে। তবু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ইউ আর এ ব্র্যান্ডেড কাটথ্রোট দয়ী আন্টি।
রিয়েলি?– বলে দয়ী → তুলে হাসে। তারপর বলে, তুই বোকার মতো ধামাটা হড়াস করে। তুলে ফেললি কেন রে? আমি হাত ঢুকিয়ে একটা একটা করে ধরে বের করতাম। নাউ হেলপ মি। টু ক্যাচ দেম।
ঝটাপটি করে দুজনে মিলে আরও পাঁচটা মুরগি ধরল। ভীষণ চেঁচাচ্ছিল মুরগিগুলো। চোখের সামনে বন্ধুদের রক্তমাখা লাশ দেখে কিছু বুঝে নিয়েছিল তারা। ছ নম্বরটায় সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ ছিল। একটা তাকের ওপর উঠে বসেছিল সেটা। বাবুন আল ছুঁড়ে সেটাকে ওড়াল তো বসল গিয়ে আলোর শেডের ওপর। আলু ছুঁড়তে গিয়ে বালবটা ভাঙল বাবুন। কাঁচে হাত কাটল দয়ী। ঘেমে চুমে একাকার হল। মুরগিটা কোক-কোঁক করে আতঙ্কিত চিৎকারে ঘর ভরে দিল, তারপর প্রাণভয়ে ঘুরতে লাগল চারপাশে।
বাবুন ফ্যাকাসে মুখে বলে, লিভ ইট আন্টি। লেট ইউ গো।
দয়া বলে, লাভ নেই রে বাবুন। আমরা ছেড়ে দিলেও আর কেউ ধরে খাবে। কিপটে বাপের পয়সা নষ্ট করবি কেন? আয় ধরে ফেলি।
ড্যাড ইজ নো মাইজার।-বাবুন বলে।
হি ইজ।
বলে একটা জলচৌকির ওপর উঠে খুব সাবধানে কাপপ্লেটের র্যাকের ওপর বসে থাকা মুরগিটার দিকে হাত বাড়ায় দয়ী।
পিছন থেকে বাবুন মৃদু স্বরে বলে, ইউ হ্যাভ এ নাইস ফিগার আন্টি। থার্টি সিক্স টোয়েন্টি ফাইভ থার্টি সিক্স।
হাসতে গিয়ে মুরগিটা উড়ে পালাল। দয়ী বলে, খুব পাকা হয়েছিস বাবুন। স্কুলে এসব শেখাচ্ছে বুঝি!
সিওর। উই ইভন ডেট দি গার্লস।
মাই গড!
মুরগিটা গ্যাস সিলিন্ডারের পিছনে লুকোতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়ল। নড়তে পারল না। দয়ী হাত বাড়িয়ে ঠ্যাং ধরে টেনে আনল সেটাকে। বলল, আমরা যখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তাম তখন এত পাকা ছিলাম না।
আই নো ইউ হ্যাড এ বানচ অফ লাভারস।
মারব থাপ্পড়।– বলে হাসিমুখেই দয়ী মুরগিটার গলা নামিয়ে দিল।
কাট থ্রোট। বাবুন বলে।
দরজায় টোকা দিয়ে মৃন্ময়ী সভয়ে বলে, কী করছিস তোরা ভিতরে? কী ভাঙলি ও বাবুন? মুরগিগুলো অমন চেঁচাচ্ছিল কেন রে? আমি বাথরুমে পর্যন্ত থাকতে পারছিলাম না চেঁচানিতে।
বাবুন মৃদুস্বরে বলে, শি ইজ এ মেন্টাল কেস।
দয়ী বলে, ওরকম বলতে নেই বাবুন।
শি হ্যাড অলসস এ লাভার ইউ নো। এ ব্যাড গাই।
দয়ী স্তম্ভিত হয়ে যায়। জামাইবাবু কি ছেলের কাছেও মৃন্ময়ীর অতীত ঘটনা খুলে বলেছে! লজ্জায় লাল হয়ে গেল সে। কঠিন চোখে বাবুনের দিকে চেয়ে বলে, হু টোন্ড ইউ?
বাবুন চাউনি দেখে একটু ভয় পেয়ে অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলে, আই নো। এভরিওয়ান নোজ।
দয়ী বন্ধ দরজা খুলে দিয়ে বলল, আয় দিদি, হয়ে গেছে।
মৃন্ময়ী দরজার কাছ থেকেই দৃশ্যটা দেখে শিউরে ওঠে। ভাঙা ডানা, ছেঁড়া পালক, রক্ত মাখামাখি। ছটা বিচ্ছিন্ন মাথা গড়াগড়ি যাচ্ছে একধারে, অন্য ধারে পাকার মুরগির শবদেহ। মৃন্ময়ী বলল, আহা রে! কষ্ট দিসনি তো ওগুলোকে দয়ী?
কষ্ট কী? মরে বেঁচেছে।
বাবুন তার ছুরি বন্ধ করে পড়ার টেবিলে ফিরে গেছে।
দয়ী মুরগির পালক ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, বাবুনটাকে তোরা কি শাসন করিস না দিদি? ও কীসব যেন বলছিল!
মৃন্ময়ী তার ভেজা এলোচুলে গামছার ঝটকা দিচ্ছিল দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে। থেমে গিয়ে বলল, কী বলছিল?
তোর লাভারের কথা।
মৃন্ময়ী উদাস মুখে বলে, সবাই বলে, ও-ই বা বলবে না কেন?
দয়াময়ী মুখ তুলে কঠিন স্বরে বলে, না, বলবে না। বললে ওর মুখ থেঁতো করে দিবি। তোর ভয় কীসের?
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলে, পেটে ধরলে তো হয় না, বাবুন তো আমার নয়। ওর বাবার।
দয়ী কথা বাড়ায় না। অনেক কাজ।
বিকেল হয়ে আসতে না আসতেই মৃন্ময়ী তাড়া দেয়, রান্না তাড়াতাড়ি শেষ কর। হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আয়। আমি শাড়ি বের করে রেখেছি।
আমি সাজব না দিদি। রান্না করতে ডেকেছিলি, করে দিয়ে গেলাম।
শুধু তাই বুঝি? বোকা কোথাকার!– মৃন্ময়ী খুব ভাল মানুষের মতো মুখ করে বলে, কত ভাল ছেলে জানিস না তো! এরকম আর কপালে জুটবে না।
জুটে দরকার নেই।
বলে বটে দয়ী, আবার সাজেও।
.
বেলা থাকতেই সরিৎ অফিস থেকে ফিরল। মোটা-সোটা নাড়ুগোপালের মতো চেহারা, কিন্তু কঠিন এক বোকা ব্যক্তিত্ব। দেখলেই মনে হয় এ লোকটা তেমন বুদ্ধিমান নয়, তবে জেদি এবং গোঁয়ার। সব সময়ে মুখে একটা অহংকারী গম্ভীর ভাব। হাসি ঠাট্টা করে না, গল্প জমাতে বা আড্ডা মারতে ভালবাসে না, গান গায় না, বই পড়ে না। তার সব মনোযোগ ছেলের ওপর। অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধধায়ার আগেই ছেলের পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে, সেদিনকার স্কুলের পড়া দ্যাখে। বিকেল হলে ছেলেকে খেলতে নিয়ে যায় পার্কে। রাত্রিবেলা ফের ছেলেকে পড়াতে বসে৷ এ জীবনে আর কোনও আনন্দ বা অবকাশের তোয়াক্কা করে না। মৃন্ময়ীর সঙ্গে কদাচিৎ কেউ তাকে কথা বলতে শুনেছে। তবে এও সত্য যে, মৃন্ময়ী সম্পর্কে নোংরা কৌতূহলেরও তার অভাব নেই। এখনও সে মৃন্ময়ী সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়, অতীতের আরও কোনও গুপ্ত ইতিহাস আছে কি না জানার চেষ্টা করে। লোক্টাকে আদপেই পছন্দ করে না দয়ী।