মৃন্ময়ীকে এই গহ্বর থেকে কোনওদিনই বোধহয় আর টেনে তোলা যাবে না।
সেই ঘটনাটার কথা সঙ্কোচবশে কখনও দিদিকে জিজ্ঞেস করেনি দয়ী। তখন দয়ী খুব ছোট। দিদিকে ফিরিয়ে আনা হল বাড়িতে। দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় একটা তালাদেওয়া ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকত সারা দিন। কাঁদত না, গোঙানোর মতো একরকম বোবা শব্দ করত। সারা গায়ে মারে দাগ। চুল ছেঁড়া, ঠোঁট রক্তাক্ত। বিভীষিকার মতো দিন গেছে সেসব।
আজ দয়ী কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। বলল, দিদি, একটা কথা বলবি? লাটুকে তুই কেমন বাসতিস?
লাটু! লাটুটা আবার কে?–মৃন্ময়ী ভারী অবাক হয়।
সেই যে। যার সঙ্গে তুই চলে গিয়েছিলি!
মৃন্ময়ীর বিস্মিত মুখ হঠাৎ-স্মৃতিতে সিদুরে হয়ে গেল। দিশেহারার মতো চারদিকে এবার তাকাল, বোকার মতো হাসল, শ্বাস ফেলল। তারপর মাথা নিচু করে বলল, খুব তেজি ছিল। বেঁচে থাকলে বাবাকে হয়তো ও-ই জব্দ করত একদিন।
খুব তেজি?
সাংঘাতিক। বিশ বছর বয়স হবে না, তার মধ্যেই পাঁচ-ছটা খুন করেছিল।
তোর খুনিকে পছন্দ হল কেন?
ওই বয়সটাই ওরকম। মনে করতাম, খুনটা খুব বাহাদুরির কাজ।
তাকে খুব ভালবাসতিস?
আমি?
বলে চমকে ওঠে মৃন্ময়ী। ভয় পেয়ে মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি বলে, আমি নয়। ওই তো আমাকে সব বলত। বিয়ে করি চলো, বসনদাকে বলি চল।
তুই কিছু বলিসনি?
আমি বারণ করতাম। জানি তো, শুনতে পেলে বাবা মেয়ে ফেলবে।
তারপর?
কিন্তু ও খুব তেজি ছিল। ভীষণ সাহস। বলত, বনদা রাজি না হলেও কুছ পরোয়া নেই। চলো, ভাগব। সেই সাহস দেখেই আমি কেমন যেন সাহসী হয়েছিলাম। পালিয়ে গিয়ে কিন্তু বুঝেছিলাম, বাবার হাত থেকে বাঁচব না। সব জায়গায় বাবার লোক। ও আমাকে কালীঘাটে নিয়ে যায় বিয়ে করবে বলে। বাবা তো ভীষণ বুদ্ধিমান। বাবা ঠিক জানত আমরা কালীঘাটে যাব। সেখানে নারায়ণ নামে বাবার একজন লোক আমাদের ধরে। ট্যাক্সি করে যখন আমাদের বাগমারি নিয়ে যাচ্ছিল তখন মানিকতলা ব্রিজ পেরিয়ে নির্জন একটা রাস্তায় লাটু নারায়ণদাকে মারল। ট্যাক্সির মধ্যে। অনেকক্ষণ ধরে তক্কে তক্কে ছিল। কিন্তু নারায়ণদাও তো কম নয়। সেই সময়টা সামনে ঝুঁকে ট্যাক্সির ড্রাইভারকে রাস্তা চোচ্ছিল, লাটু আচমকা পিঠে ছোরা ঢুকিয়ে দিল। আমার কোল ভরে গেল রক্তে। দুহাতে রক্ত। কী গরম। লাটু একটুও ঘাবড়ায়নি। নারায়ণদার লাশ রাস্তায় ফেলে দিয়ে সেই ট্যাক্সি করেই আমরা পালাই। একটা বস্তিতে দুদিন, কসবায় এক রাত্রি, এক বন্ধুর বাড়িতে এক রাত্রি কাটে। স্ট্র্যান্ড রোডে মস্ত মস্ত যেসব কংক্রিটের পাইপ আছে, তার মধ্যেও ভিখিরিদের সঙ্গে এক রাত্রি কাটিয়েছি। বাবা তখন তুলকালাম করছে আমাদের খোঁজে। লাটু কখনও ভয় পেত না তাতে। তাই খুব সাহস পেতাম। লাটু যেরকম ছিল সেরকমটা এখন দেখি না।
তার মানে তুই লাটুকে ভালবাসতিস দিদি।
না না!
আর্তস্বরে বলে ওঠে মৃন্ময়ী। তারপরই নিজের গলার স্বরে চমকে ওঠে। চারদিকে চায়।
মৃন্ময়ীর স্বরটা কিছু ওপরে উঠেছিল। কাশ্মীরী কাঠের নকশা করা পারটিশনের ওপাশ থেকে বাকুন মুখ বাড়িয়ে বিরক্ত গলায় বলে, দয়ী আন্টি, হোয়াট ইজ গোয়িং অন? এনিথিং রং?
নাথিং ডার্লিং!–দয়ী বিস্ময়ের ভান করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে, জাস্ট টকিং ওভার সাম ফানি থিংস।
মৃন্ময়ী বাবুনের দিকে চেয়ে ছিল। ভয়ে সম্মোহিত তার দৃষ্টি।
বাবুন টেবিল থেকে একটা চিংড়িমাছ তুলে নিয়ে চলে যায়। দয়ী সামান্য খেয়ে উঠে পড়ে। কাজ আছে।
.
জওহরলাল নেহরু চিনে রয়্যাল খেতেন। রান্নাটা কলেজের এক বান্ধবীর কছে শিখেছিল দয়ী। মাঝে মাঝে রাঁধে। পরশুদিন মৃন্ময়ী টেলিফোন করেছিল। তার কোনও এক মাসতুতো না পিসতুতো দেওর বারো বছর ফিলাডেলফিয়ায় থেকে সদ্য এসেছে। মাত্র পাঁচ মাসের ছুটি তার। এর মধ্যেই সে পাত্রী দেখে পছন্দ করে বিয়ে সেরে বউ নিয়ে আবার ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে যাবে। আত্মীয়স্বজনরা তাকে নেমন্তন্ন করে আইবুড়ো ভাত খাওয়াচ্ছে খুব।
মৃন্ময়ী ফোনে বলেছিল, তোর সেই চিকেন রয়্যাল ওকে খাওয়াতে চাই।
দয়ী বলল, ওসব করতে যাবি কেন? বিদেশে ওরা ওসব কত খায়। তুই বরং শুক্তে মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়ান।
মৃন্ময়ী তাতে রাজি নয়। বলল, তা হয় না। তোকে আসতেই হবে। চিকেনও রাঁধতে হবে।
কেন? আমাকে আসতেই হবে কেন?
সব কথার অত খতেন নিস কেন? বলছি আসবি।
মনে মনে হেসেছিল দয়ী। মৃন্ময়ীর দেওরভায়া পাত্রী দেখতে আমেরিকা থেকে এতদূর এসেছে সেটা সে ভুলে যায়নি। তবে দয়ীর একবার পরীক্ষাটা দিতে আপত্তি নেই। যদি লোকটাকে তার পছন্দ হয় এবং তাকেও লোকটার, তবে ফিলাডেলফিয়ায় গিয়ে ঘরসংসার করতে দোষ কী? শুনেছে লোকটা সেখানে বহু টাকা রোজগার করে, একটা বাড়ি আর দু-দুটে গাড়ি আছে। দোষের মধ্যে বয়সটা ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ। হিসেবে দয়ীর চেয়ে দশ-এগারো বছরের বড়। তা হোক।
খেয়ে উঠে দয়ী আঁচল কোমরে বেঁধে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে মুরগি কাটতে বসল। সঙ্গে বাবুন। বাইরে থেকে মৃন্ময়ী দরজায় টোকা দিয়ে বলে, এগুলোকে বেশি কষ্ট দিস না দয়ী। টপ করে কেটে ফ্যাল।
একটা মস্ত ভোজালি হাতে বাবুন পাশেই দাঁড়িয়ে খুব তড়পাচ্ছিল, আই অলসো ক্যান ডু ইট আন্টি। গিভ মি ওয়ান।