মেয়েটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে তার পেরেক ঠোকা দেখল। আর তখন আরও বেশিবার আঙুল থেতলে যেতে লাগল রুকুর।
তাপস হাসছিল মাঝে মাঝে। বলল, আমাদের বাড়িতে আর বড় হাতুড়ি নেই।
এতেই হবে।- বলল রুকু।
হচ্ছে কোথায়? পেরেকের মাথায় লাগছেই না।
একটু সময় নেবে।
তুমি বুঝি স্নানে যাচ্ছিলে? দেরি হয়ে যাবে না?
আজ ছুটির দিন। দেরি হলে কিছু হবে না।
দেশের বাড়িতে তোমার কে কে আছে?
মা বাবা ভাই বোন।
বোন কজন?
চারজন।
সবাই তোমার ছোট? আর ভাই?
সবাই ছোট।
তোমার বয়স কত?
সতেরো হবে বোধহয়।
বোধহয় কেন? ঠিক জানো না?
আমি হিসেব রাখি না।
বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগে না?
আগে লাগত। এখন সয়ে গেছে।
মাসি খুব ভালবাসে বুঝি?
বাসে।
তোমার ডাকনাম তো রুকু, ভাল নাম কী?
রুক্মিণীকুমার।
বেশ নাম তো। এরকম নাম আজকাল শোনা যায় না। বলো তো বঙ্কিমের কোন উপন্যাসে এই নাম আছে?
রাধারানী।
ও বাবা, তুমি তো অনেক পড়েছ! মোটেই গাঁইয়া নও।
পাকিস্তানেও আমরা শহরেই থাকি। গাঁয়ে নয়।
কোন শহর?
ময়মনসিং।
কুচবিহারের মতো এমন ভাল শহর?
এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না, তবে এর চেয়ে অনেক বড়।
আমাদের কুচবিহারের মতো এত ভাল শহর কোথাও নেই, তা জানো? এত নিট অ্যান্ড ক্লিন শহর দেখেছ কখনও?
এইরকম সব কথা হয়েছিল সেদিন। অনেক কথা। খুব কথা বলতে ভালবাসত তাপসী। খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল তার সঙ্গে। একই ক্লাসে পড়ত তারা। কুকু জেকিনস স্কুলে, তাপসী সুনীতি অ্যাকাডেমিতে। স্কুলের সেটা শেষ বছর। তখন উপর্যুপরি ঢেউ আসত। ঢেউয়ে টালমাটাল হয়ে যেত রুকু। একা শুয়ে যখন ভাবত তখন টের পেত তার বুকের মধ্যে কাকড়া হেঁটে বেড়াচ্ছে। তেমনি তীক্ষ্ণ অনুভূতি, জ্বালা। মাঝে মাঝে ধক করে ওঠে বুক আনন্দে। এক-একদিন হোঃ হোঃ খুশির হররায় পাগল হয়ে যায় মাথা।
খুব বেশিদিন নয়। পরিচয় হওয়ার মাত্র দুমাসের মাথায় একটা ভুখা মিছিল বেরোল শহরে। স্কুল কলেজে ধর্মঘট। রাজনীতির নেতারা বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ফ্ল্যাগ-হাতে এগিয়ে দিয়েছিলেন সেই মিছিলে। সাগরদিঘির সামনে পুলিশের ব্যারিকেড। মিছিল থামবে কি এগোবে তা কেউ বলে দেয়নি। সুতরাং মিছিল ধীরে ধীরে এগোল। কী কারণে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল তা কোনওদিনই জানতে পারেনি কেউ সঠিকভাবে। সেই মিছিল এগিয়ে গেলেই বা সরকারের কী ক্ষতি হত? সাগরদিঘির শান্ত, নিরালা রাস্তার ওপর মোট চারজন গুলি খেয়ে মরে গেল। আর কী আশ্চর্য! সেই চারজনের মধ্যে একজন তাপসী।
খবর পেয়ে শহর ভেঙে পড়েছিল সেখানে। পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল রুকুও। দেখল, তাপসীর নতুন যৌবনে ফুটে ওঠা একটি স্তন বিদীর্ণ করে পাঁজর ফাটিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। একটা গুলিতে অত বড় ক্ষত হতে পারে তা জানা ছিল না রুকুর। ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সে।
তাপসী কোনওদিন রাজনীতি করেনি, মিছিল-টিছিলেও যায়নি। সেবার জোর করে স্কুল থেকে কয়েকজন বড় মেয়ে তাদের কয়েক জনকে ধরে নিয়ে যায়।
কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। তাপসী মরে যাওয়ার পর রুকুর কয়েকদিন কাটল মানসিক অন্ধকারে। ভিতরে একটা দিশেহারা নিরালম্ব ভাব। সেটা কি গভীর শোক? নাকি সেই গুলির ক্ষত দেখে বিস্ময়মিশ্রিত ভয়? আজও ভাবলে হাসি পায়, তাপসীর মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন সে সন্ধের পর একা থাকতে ভয় পেত। মনে হত, তাপসীর ভূত এসে দেখা দেবে। তবে কী করে সে বলবে যে তাপসীর প্রতি তার ভালবাসা ছিল?
মৃত্যুর বেশ কিছুদিন বাদে তাপসীর মা এসে একদিন মাসির কাছে বলেছিল, আর তো কিছু মনে হয় না, শুধু ভাবি মেয়েটা মরার সময়ে কত না জানি ব্যথা পাচ্ছিল, হয়তো মা বলে ডেকেছিল কতবার। ওই শেষ সময়টায় ওর কাছে তো কেউ ছিল না, কে জানে তখন তেষ্টা পেয়েছিল কি না, খিদে পেয়েছিল কি না!
শুনে ভারী ছিছিক্কার বেজেছিল রুকুর মনে। কই, সে তো কখনও মায়ের মতো তাপসীর মৃত্যুযন্ত্রণার কথা ভাবেনি!ভাবেনি তো, শেষ সময়ে ওর জলতেষ্টা পেয়েছিল কি না! পিচের রাস্তায় এক ভিড় লোকের মধ্যে, জলজ্যান্ত দিনের আলোয় নিজের রক্তে মেখে এক বুক ক্ষতের যন্ত্রণায় হাফাতে হাফাতে মৃত্যুর মধ্যে একা ডুবে যেতে কেমন লেগেছিল তাপসীর, তা কখনও অনুভব করার চেষ্টাও করেনি রুকু। না করলে ভালবাসা কী করে হল?
বার বার ঘটনাটা ভাজে ভাজে খুলে ভেবে দেখেছে রুকু। আজও সন্দেহ রয়ে গেছে, তাপসীকে সে ভালবেসেছিল কি না। মন বলে, বেসেছিল। যুক্তি বলে, না। তাপসী যদি আজও বেঁচে থাকত তবে কী হত? নিশ্চিত বলা যায়, রুকুর সঙ্গে তার বিয়ে হত না।
কারণ রুকুর বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই তাপসীর বিয়ের বয়স হয়ে যেত। তাছাড়া, সমানবয়সি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে বাধা আসত। কে জানে হয়তো তাপসীই রাজি হত না। আর যদি অঘটনক্রমে বিয়ে হতই তবে তাপসীকে আজ কেমন লাগত রুকুর? হয়তো ভাল নয়, হয়তো। একঘেয়ে, হয়তো মনকষাকষি। এসবই তো হয়। রুকু জানে।
জুডিসিয়াল এনকোয়ারি বসল ল্যান্সডাউন হলে। রোজই সেই শুনানিতে যেত রুকু। বার বার তাপসীর নাম উঠত। কুকুর অল্পবয়সি মন চাইত, কঠোর প্রতিশোধ। কিন্তু সেই তদন্তে কিছুই হল না, কেউ শাস্তি পেল না। পুলিশের বড় অফিসারকে শুধু বদলি করে দেওয়া হল।