দয়ী গম্ভীর মুখ করে বলল, খুনের প্রশ্ন ওঠে না।
তবে তুমি ওকে নিয়ে অত ভাবছ কেন দয়ী? ও ভাংচি দেবে ভয়ে?
দয়ী মাথা নেড়ে বলে, ভাংচি-টাংচি সেকেলে ব্যাপার। যে লোকটির সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে সে অনেক বেশি মডার্ন। আমার জামাইবাবুর সম্পর্কে ভাই। তার সঙ্গে যাতে আমার বিয়েটা
হয় সেজন্য জামাইবাবু যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। কোনও কাজ হয়নি। আমাকে লেখা মলয়ের একটা চিঠি পর্যন্ত জামাইবাবু তাকে দেখিয়েছেন। লোকটা তাতেও দমেনি। বিয়ে সে আমাকে করবেই।
তবে আটকাচ্ছে কোথায় দয়ী?
দয়ী অবাক হয়ে বলে, কোথাও আটকাচ্ছে না তো! বিয়েটাও খুব নির্বিঘ্নে হয়ে যাবে। কিন্তু পুরুষদের আমি খুব চিনি রুকু। লোকটা বিয়ে করবে বটে কিন্তু তার কমপ্লেকস শুরু হবে বিয়ের পর থেকে। মলয়ের ব্যাপারটা সে খুব ভালভাবে জানে না। একটা প্রেমপত্র থেকে খুব বেশি কিছু আন্দাজ করাও সম্ভব নয়। স্পোর্টসম্যানের মতো সে তাই এখন ব্যাপারটা গায়ে মাখছে না। কিন্তু বিয়ের পর সামান্য খটাখটি লাগলেই তার মনে নানারকম কমপ্লেক্স দেখা দেবে। জানতে চাইবে মলয়ের সঙ্গে আমার কতদূর কী হয়েছিল। লোকটা এমনিতে ভাল, কিন্তু ভীষণ প্রাকটিক্যাল কোনও কিছুকেই সাবলিমেট করতে জানে না।
রুকু নিজের কপাল টিপে ধরে বলে, ওঃ দয়ী, আমার বোকা মাথায় এই সব শক্ত কথা একদম ঢুকছে না। সরল করে বলল।
দয়ী হাসল। বলল, সোজা কথায় লোকটাকে বিয়ে করতে আমার ভয় হচ্ছে। আমেরিকা তো এখানে নয়। সেই দূর দেশে যদি কখনও আমার কান্না পায় তবে সম্পূর্ণ একা একা কাঁদতে হবে। কাউকে কিছু বলার থাকবে না। আমার বড় ভয় করছে রুকু।
রুকু মহান গলায় বলে, তার জন্য তুমিই দায়ী দয়ী। এখন কী করতে চাও?
সেইজন্যই তোমার কাছে আসা। বলো তো কী খবর? আজও বিনয়ের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ক্যালকাটা ক্লাবে ওর এক বন্ধু পার্টি দিচ্ছে। রোজই আমরা একটু একটু করে আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এ আসছি। এই সময়টাই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
রুকু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবে। তারপর বলে, ভবিষ্যতে কী হবে তা কেই বা জানে? আমি বলি তুমি বরং লোকটাকে বিয়ে করে আমেরিকাতেই চলে যাও। হয়তো লোকটা সবই ক্ষমা করে নেবে।
দয়ী মাথা নেড়ে কুঁকে স্টিয়ারিং হুইলে মাথাটা নামিয়ে রাখে। মৃদুস্বরে বলে, জামাইবাবুও ওর কানে অনেক বিষ ঢেলেছে তো। যতদূর খবর পেয়েছি জামাইবাবু মলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। বিনয়ের মুখোমুখি ওকে দাঁড় করাবে। অবশ্য তাতেও বিয়ে আটকাবে না আমি জানি। বিনয় অসম্ভব গোঁয়ার। কিন্তু বিষটা থেকে যাবে যে রুকু।
.
দয়ী
বিনয় খুব সামান্যই মদ খায়। সিগারেটেও তার তেমন নেশা নেই। তার আসল নেশা হল কাজ। পার্টি শেষ হল রাত দশটা নাগাদ। পার্টিতে আজ তেমন হুল্লোড় ছিল না, লোকজনও ছিল কম। মদের ঢল নামেনি, মাতলামির বাড়াবাড়ি হয়নি। যে আজ পার্টি দিয়েছিল বিনয়ের সেই বন্ধু অজিত ঘোষ দয়ীর হাতে এক গ্লাস শেরি ধরিয়ে দিয়েছিল। সেটাতে একটা বা দুটো চুমুক হয়তো দিয়েছিল দয়ী, এমন সময় বিনয় খুব নিরীহভাবে কাছে এসে তার কানে অস্ফুট কী একটু বলে হাত থেকে সুকৌশলে গ্লাসটা নিয়ে এক গ্লাস সফট ড্রিংক ধরিয়ে দিয়ে গেল। অবাক হলেও দয়ী প্রতিবাদও করেনি। সামান্য একটু অপমান অবশ্য বোধ করেছিল সে। কচি খুকি তো সে নয় যে, অন্য কেউ তাকে ইচ্ছেমতো চালাবে। মনটা বিরূপ ছিল বলেই বাদবাকি সময়টা সে পার্টির আনন্দটুকু মোটেই উপভোগ করেনি। দায়সারা কথাবার্তা বলল, একটা মাত্র মুরগির ঠ্যাং নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেখে দিল।
পার্টি শেষ হলে দয়ীর গাড়িতেই এসে উঠল বিনয়। ওঠার কথা নয়। কারণ বিনয় দয়ীর উলটোদিকে থাকে। নর্থে। বিনয় খুব নরম গলায় বলল, অনেকটা রাত হয়েছে। এত রাত্রে তোমাকে একা যেতে দেওয়া ঠিক নয়। আমি তোমার বাড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে ফিরব।
দয়ী ভ্রু কুঁচকে বলল, আমার বেশি রাতে ফেরা অভ্যাস আছে।
কথাটা বলে দয়ী অপেক্ষা করল। কিন্তু বিনয় গাড়ি থেকে নামার লক্ষণ দেখাল না। দয়ী তাই গাড়ি চালু করে বলে, কলকাতা শহরে কিন্তু ইচ্ছেমতো ট্যাক্সি পাওয়া যায় না।
বাস আছে। বিনয় শান্ত স্বরে বলে, না হয় কিছু একটা ঠিক জুটে যাবে।
আমার কোনও পাহারাদারের দরকার নেই। একা আমি বেশ চলতে পারি।
বিনয়ের মুখে হাসি নেই, গাম্ভীর্যও নেই। কথা একটু কম বলে। চুপচাপ নির্লজ্জের মতো বসে রয়েছে। দয়ী ভবানীপুর পর্যন্ত চলে এল বিনা সংলাপে। তারপর বিনয় হঠাৎ বলল, আমি পিউরিটান নই। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে কেউ মদ খেলে আমার ভাল লাগে না। তুমি কিছু মাইন্ড করলে নাকি?
দয়ী দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, ভাল মন্দ বুঝবার বয়স আমার হয়েছে।
বিনয় মৃদুস্বরে বলে, আই অ্যাম সরি। আমি ভাবলাম, অতটা শেরি খেয়ে গাড়ি চালাতে তোমার কষ্ট হবে। তাছাড়া এই গরমে কোনওরকম অ্যালকোহলই শরীরের পক্ষে স্বস্তিকর নয়।
আমি মোটেই অতটা খেতাম না। গাড়ি চালাতে হবে সেটা কি আমার খেয়াল ছিল না ভদ্রলোক দিলেন, ভদ্রতা করে নিতে হয় বলে নিলাম। খেতাম না।
ব্যাপারটা ভুলে যাও দয়ী। আমার ভুল হয়েছিল।
দয়ী কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। লোকটাকে তার কখনও খারাপ লাগেনি। কিন্তু সেটাই বড় কথা নয়। সে বলল, সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে গেলে আগে থেকেই একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া থাকা ভাল বিনয়।