সইকুমার হাসল। ঝকঝকে দাঁত। বলল, ইট গোজ বিগার অ্যান্ড বিগার।
তারপর?
মার্কেট পেয়ে যাবেন, প্রোডাকশন বাড়তে থাকবে, এর মধ্যে কোনও তারপর নেই। এজেন্সির চেয়ে প্রোডাকশনের ইজ্জত বেশি।
মলয় তা জানে। তবু মনশ্চক্ষে সে একটা দাবার ছক দেখতে পায়। প্রতিপক্ষ খুব ভাল মানুষের মতো আপাততুচ্ছ চাল দিচ্ছে। সেই চাল কতটা বিপজ্জনক তা তাকে ভেবে দেখতে হবে। সইকুমারকে সোজাসুজি না বলতেও সে পারছে না। কারণ, ইচ্ছে করলে ও নিজের টাকাতেই প্রোডাকশনে নামতে পারে। কিন্তু যেহেতু মলয়কে টানতে চাইছে সেইজন্যই মলয়ের লোভ এবং সন্দেহ।
নিঃশব্দে পুণ্য এসে সইকুমারকে চা দিয়ে গেল। সঙ্গে দুটো বিস্কুট।
সহকুমার তার ডান হাতের ঢিলা ব্যান্ডে বাঁধা মস্ত ঘড়িটার দিকে চাইল। বিদঘুঁটে ঘড়ি। ডায়ালের মধ্যে ছোট ছোট আরও গোটা কয়েক ডায়াল। একগুচ্ছের টাকা গেছে। সইকুমার বলল, দি ওয়েদার ইজ হেল। আজ গাড়ি নিয়ে ফেঁসে যাব।
চা খেয়ে সইকুমার উঠল। বলল, তা হলে ব্যান্ডেল কবে যাবেন? গাড়িতে ম্যাকসিমাম ওয়ান আওয়ারস জার্নি। একটু আউটিংও হবে। হাউ অ্যাবাউট নেক্সট সানডে?
দেখছি। আমি তোমাকে ফোনে জানাব।
সইকুমার চলে গেলে মলয় ধৈর্যভরে টেলিফোন করে করে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন মালের অর্ডার দিল। বাঁকুড়ার বহু এজেন্ট তার হাতে এসে গেছে। সঙ্গে করে সে প্রায় দুলাখ টাকার অর্ডার অনেছে, অনেক কাজ। আবহাওয়া এরকম না হলে সে নিজে গিয়ে কয়েকটা সাপ্লায়ারের সঙ্গে দেখা করত। বইরে ঝড় কমেছে বটে, কিন্তু চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে তুলে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। দরজার কাঁচে জল জমে আছে। অন্ধকার এবং বদ্ধ বাতাসের ভ্যাপসা গরম আটকে আছে ঘরের মধ্যে। আগে বৃষ্টিকে সে বৃষ্টি হিসেবেই দেখত। আকাশ থেকে জল পড়ছে আজকাল রোদ বা বৃষ্টির সঙ্গে চাষবাস এবং তার নিজের ব্যাবসাকে জড়িয়ে সে হিসেব করে।
চিঠিপত্রের একটা ছোটখাটো ডাই জমেছে। মলয় আবছা আলোয় কয়েকটা খুলে দেখল। ভাল পড়া যায় না। তাই আর চেষ্টা করল না। বসে বসে রুকুর কথা ভাবতে লাগল। রুকুর এমন কী জরুরি দরকার?
ভাবতে ভাবতে পাঁচ মিনিটও যায়নি, রুকু এসে হাজির। ছাতাটা মুড়ে দরজায় ঠেসান দিয়ে রাখতেই সেটা থেকে অঝোর জল ঝরে পড়তে থাকে। রুকুর জামাকাপড়ও সপসঙ্গে ভেজা। ছাতায় বৃষ্টি তেমন আটকায়নি বোঝা যাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই বলল, আজ আর বাড়ি ফেরা যাবে না দেখছি। রাস্তায় গোড়ালি সমান জল জমে গেছে। ট্রাফিক জ্যাম। ট্রাম বন্ধ।
মলয় স্থির চোখে চেয়ে দেখছিল রুকুকে। কোনও কথা বলল না। বৃষ্টিতে কলকাতার কী দুর্দশা হতে পারে তা তার চেয়ে বেশি আর কে জানে?
রুকু এক গাল হেসে বলল, সারা পথ ভিজতে ভিজতে এলাম, আর যেই তোর অফিসের দোরগোড়ায় এসেছি অমনি বৃষ্টি থামল।
থেমেছে!–বলে লাফিয়ে ওঠে মলয়। গিয়ে এক ঝটকায় বারান্দার দরজা খুলে ফেলে। হা হা করে ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাঁপিয়ে ঘরে ঢোকে। দু-একটা জলকণাও সঙ্গে আসে বটে, তবে বৃষ্টি বাস্তবিকই থেমেছে।
মলয় ঘড়ি দেখে বলল, এখনও সময় আছে। দু-একটা অফিসে ঢু মারতে পারা যায়। তোর কথাটা চটপট সেরে ফেল।
রুকু দুঃখিত মুখ করে বলে, পুরনো বন্ধুকে এভাবে ঘাড়ধাক্কা দিতে হয়! দয়ী ঠিকই বলে, তুই আর আগের মতো নেই।
আগের মতোই চিরকাল যারা থেকে যায় তারা ইন্মাচুয়োরড। আমার কাজ-কারবার সবার আগে, তারপর সময় থাকলে ফ্রেন্ডশিপ। এখন গা তোল তো বাপ।
কোথায় যাবি?
চল তো।
রুকু ওঠে। অফিস থেকে বেরিয়ে বাঁ হাতে কিছু দূর হেঁটে মলয় তাকে একটা দেড় তলার রেস্তরাঁয় নিয়ে আসে। টেরিটিবাজারে এমন চমৎকার ছিমছাম রেস্তরাঁ আছে তা যারা না জানে তারা ভাবতেও পারবে না।
মলয় টেবিলে কনুই রেখে ঝুঁকে বসে বলল, বল এবার।
রুকু কোনও ভণিতা করার সময় পেল না। চিরকালই মলয় কাঠখোট্টা গোছের। সোজা কথা বলতে এবং শুনতে পছন্দ করে। রুকু তাই চোখ বুজে বলে ফেলল, তুই দয়ীর পিছনে লেগেছিস কেন?
তোকে কি দয়ী একথা বলেছে?
বলেছে এবং বলছে। প্রায় রোজই টেলিফোন করে।
কী বলছে?
বলছে তুই ওকে বিয়ে করতে চাস। ও রাজি নয়।
তুই কি ওর সেভিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখছিস? আমি ওকে বিয়ে করতে চাইলে তুই ঠেকাতে পারবি?
রুকু সামান্য অবাক হয়ে বলে, এটা গুহামানবদের যুগ নয় মলয়। নেগোশিয়েশনের যুগ। গা-জোয়ারি করছিস কেন? চাইলে বিয়ে করবি। তাতে কী? কিন্তু দয়ীরও তো মতামত আছে।
এবার মলয় সামান্য হাসল। টেবিলের কাছে একটা বেয়ারা এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আলুর চপ, ঘুগনি আর চায়ের কথা বলে মলয় কিছুক্ষণ পিছনে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে সোজা হয়ে রুকুর দিকে চেয়ে বলল, সারাদিন দয়ীর কথা আমি পাঁচ মিনিটও ভাবি না। আমি কস্মিনকালেও দয়ীর প্রেমে পড়িনি। তবু আমি মনে করি দয়ীর আমাকেই বিয়ে করা উচিত।
কেন?
কারণ দয়ী আমার সঙ্গে একাধিকবার শুয়েছে।
শুনে রুকু কিছুক্ষণ কথাটার নির্লজ্জতায় স্তম্ভিত হয়ে রইল। তারপর বলল, সেটাই কি যথেষ্ট কারণ?
সেটাই একমাত্র কারণ রুকু।
দয়ী তো এই কারণকে আমল দিচ্ছে না।
দেওয়া উচিত। শরীরটা তো ফ্যালনা নয় যে শরীরের সম্পর্কটা উড়িয়ে দিতে হবে।
রুকু করুণ একটু হেসে বলল, দয়ী তোকে শরীর হয়তো দিয়েছে, কিন্তু মন বলেও তো একটা কথা আছে!