- বইয়ের নামঃ ক্ষয়
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. রুকু
ক্ষয় – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
॥ রুকু ॥
রুকু, আমার একটা প্রবলেমের কথা তোমাকে বলব?
বলবে? বলতে পারো। কিন্তু আমার নিজেই অনেক প্রবলেম দয়ী।
দয়ী একটু হাসল টেলিফোনে। বলল, তোমার প্রবলেমের কথা আর একদিন হবে রুকু। সেদিন আমার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদো। কিন্তু আজ আমারটা শোনো। ভীষণ প্রাকটিক্যাল প্রবলেম।
রুকু খুব সাবধানি গলায় বলে, শোনো দয়ী, যদি বলতেই হয় তবে রেখে-ঢেকে বোলো। এই টেলিফোন কিন্তু ডাইরেকট নয়। ইচ্ছে করলে অপারেটর শুনতে পারে। তা ছাড়া আমার তো এক্সকুসিভ টেলিফোন নেই। যার টেবিলে টেলিফোন সে এইমাত্র বাইরে গেল, যখন তখন এসে পড়তে পারে।
এগুলোই কি তোমার প্রবলেম রুকু?
এগুলোও। তবে আরও আছে। অনেক। গরিবদের যে কতরকম থাকে।
বাজে বোকো না। তুমি এক কাড়ি টাকা মাইনে পাও, আমি জানি।
আমার পে-স্লিপটা তোমাকে একদিন দেখাব। দেখো, সেখানেও কত প্রবলেম।
ইয়ার্কি বন্ধ করে একটু শুনবে? খুব জরুরি কথা।
শুনছি।
তুমি মলয়কে একটু বুঝিয়ে বলবে যে, ও যা চাইছে তা হয় না।
কী হয় না দয়ী?
তুমি জানো না বুঝি? মলয় তোমাকে কিছু বলেনি?
মলয়ের সঙ্গে আমার দেখাই হয় না প্রায়। কী হয়েছে?
ও আমাকে নিয়ে ভাবছে। অ্যান্ড হি ইজ সিরিয়াস।
একটু খুলে বলো। কিছু বুঝতে পারছি না।
তুমিই তো খোলাখুলি কথা বলতে বারণ করলে।
আই উইথড্র।
অপারেটর শুনছে না তো!
শুনুকগে। বলো।
মলয় ইজ বিয়িং প্রিমিটিভ।
তার মানে?
ও বোধহয় বিয়ে-টিয়ের কথা ভাবছে।
রুকু একটু চুপ করে থাকে, তারপর শান্ত ব্যথিত স্বরে বলে, ও।
শোনো রুকু, অত নিরাসক্তভাবে ব্যাপারটা নিয়ো না। একটু সিরিয়াস হও। ও বোধহয় সত্যিই আমার প্রেমে পড়েছে। আগের মতো হাসিখুশি ইয়ারবাজ নেই, দেখা হলেই গম্ভীর হয়ে যায়। ভাল করে তাকায় না।
সেটা কি প্রেমের লক্ষণ দয়ী? বরং উলটোটাই তো।
তোমাকে বলেছে।
তবে?
ও আমাকে লম্বা লম্বা চিঠি লেখে যে আজকাল। তাতে সব সেই বিয়ে-টিয়ের মতো সেকেলে বিষয় থাকে। আমি একটারও জবাব দিইনি।
দাওনি কেন?
বাঃ, চিঠি চালাচালির কী আছে বলো। প্রায়ই তো দেখা হচ্ছে। আমি একদিন ওর চিঠির প্রসঙ্গ তুলেছিলুম, ও গম্ভীরভাবে বলল চিঠির জবাব চিঠিতেই নাকি দিতে হবে। কী বোকামি বলো তো?
তুমি তো ওকে পছন্দই করতে দয়ী?
সে তো অনেককেই করি।
তুমি ওর সঙ্গে ধলভূমগড় বেড়াতে গিয়েছিলে। একবার কোনও ডাকবাংলোয় ছিলেও দু-একদিন।
এখন বুঝি অপারেটর শুনছে না রুকু? টেবিলের ভদ্রলোক বুঝি ফিরে আসেনি? শোনো রুকু, জ্যাঠামশাইয়ের মতো কথা বোলো না। কোথাও বেড়াতে যাওয়া কিংবা এক সঙ্গে দু-একদিন কাটানো মানেই কি প্রেম?
মানে তো জানি না দয়ী। ঠিক মানে হয়তো তুমি জানো। তবে ওরকমই একটা ভুল অর্থ সকলেই করে নিতে পারে।
তুমিও প্রিমিটিভ রুকু।
আমি কেবল লজিক্যাল হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে লজিক্যাল হতে যাওয়াটা পৃথিবীর পয়লা নম্বরের বোকামি।
তোমার লজিকটা তোমার পার্সোনাল। নিজের ব্যক্তিগত যুক্তি অনন্যর ওপর খাটানো কি ঠিক?
বাদ দাও। মাপ চাইছি। এবার যা বলছিলে বলল।
তুমি সিরিয়াস হচ্ছে না রুকু। মলয় আমার বন্ধু, তুমি যেমন বন্ধু। তোমাদের কাউকে বিয়ে করার মানে একটা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া। ওরকমভাবে ভাবিনি তো তোমাদের কোনওদিন। মলয় সেটা বুঝতে চাইছে না। কী সুন্দর হুল্লোড়বাজ মজাদার ছেলেটা এখন কেমন প্যাচামুখো, গম্ভীর আর আনইন্টারেস্টিং হয়ে গেছে। ইদানীং তোমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি?
রুকু শান্তস্বরে বলে, গত সপ্তাহে ও আমাকে মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে ব্যান্ডেল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল।
কোনও কথা হয়নি আমাকে নিয়ে?
না। ও আমাকে দিল্লি রোডে মোটরবাইক চালানোর তালিম দিয়েছিল অনেকক্ষণ। আমি কিছুতেই শিখব না, কিন্তু ও শেখাবেই। আমি ওকে বললাম, মোটর বাইক চালাতে শিখে আমার কোনও লাভ নেই, কেননা কোনওদিনই মোটরবাইক কেনার মতো পয়সা আমার হবে না। কিন্তু ওকে তো জানো।
জানি বলেই ভাবছি। তোমরা কি ওকে ভয় পাও রুকু?
হয়তো পাই।
কেন, ও কনডেমড খুনি বলে?
আস্তে দয়ী। এসব কথা টেলিফোনে কেন?
আমার কথাটার জবাব দাও।
সম্ভবত সেটাও একটা কারণ।
আমি কিন্তু সেই কারণে চিন্তিত নই। বরং ওটাই আমার কাছে ওর যা কিছু অ্যাট্রাকশন। ও যা করেছে তা পলিটিক্যাল কারণে।
আমাদের অফিসের টেলিফোন অপারেটাররা মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই লাইন কেটে দেয়। আজ দিচ্ছে না কেন জানো?
ইয়ার্কি মেরো না রুকু, কেন?
কাটছে না, কারণ অনেক স্কুপ নিউজ পেয়ে যাচ্ছে।
টেবিলের ভদ্রলোক ফিরে আসেনি তো?
এখনও নয়।
শোনো রুকু, মলয়কে তুমি একটু বোঝাবে?
ও বুঝবে কেন? মলয়কে কোনওদিন কেউ কিছু বোঝাতে পারেনি।
তুমি আমাকে অ্যাভয়েড করছ?
না দয়ী। আমি বাস্তব অসুবিধার কথা বলছি। আমার চেয়ে মলয়ের আই কিউ বেশি, বুদ্ধি বেশি, যুক্তির ধার বেশি, মলয় আমার চেয়ে ঢের বেশি সফল। ওর তিনশো সি সির হোন্ডা মোটরবাইক আছে, আমার যা জন্মেও হবে না। এমনকী ওর যে আর একটা অ্যাডেড অ্যাট্রাকশনের কথা তুমি বলেছিলে তাও আমার নেই। ছেলেবেলায় আমি কৌতূহলবশে একটা কুকুরছানাকে আছাড় দিয়েছিলাম। সেটা মরে যায় তক্ষুনি। সেই অপরাধবোধ আমার আজও আছে।