বন্দনা ঠোঁট উল্টে বলে, কে জানে কী হচ্ছে। তোর অত জেনে কী হবে?
বিলু গম্ভীর হয়ে বলল, এ বাড়িতে কেউ আমাকে কিছু বলতে চায় না। এটা খুব খারাপ নিয়ম। রমা মাসি নাকি চলে যাচ্ছে।
হ্যাঁ। গেলে বাঁচি।
কিন্তু রমা মাসি তো খুব ভাল। আমাকে কত গল্প বলে।
ছাই ভাল।
রমা মাসি সকালে উঠল। শরীর অসম্ভব দুর্বল। তাই নিয়েই বাক্স গোছতে বসল। খোলা দরজা দিয়ে বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে মাঝে মাঝে দেখছিল বন্দনা। গোছানোর মতো তেমন কিছু আনেনি মাসি। সামান্যই কখানা কাপড়চোপড়। তবে মা বেশ কয়েকখানা শাড়ি দিয়েছিল মাসিকে। সেগুলো মাসি সরিয়ে সাজিয়ে রাখল বিছানায়, বাক্সে ভরল না।
বেলা দশটা নাগাদ মা ওপরে উঠে এল। সোজা গিয়ে রমা মাসির ঘরের দরজায় দাঁড়াল। বলল, খাবি আয়। না খেয়ে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। তুই উপোস করছিস আর উনি মাতাল হয়ে ফিরছেন। প্রেমের জ্বালা তো দেখছি সাতিক।
রমা মাসি বসে ছিল মেঝেতে। পাশেই খাট। মাসি মাথাটা বিছানায় নামিয়ে দিয়ে কাঁদতে লাগল, কেন অমন করে বলছ রেণুদি? আমি কী করেছি?
মা ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, কী করেছিস তাও কি বলে দিতে হবে? সর্বনাশী! যা করেছিস তা রাক্ষুসি ছাড়া কেউ করে? এখন দয়া করে এখানে দেহত্যাগ কোরো না। আত্মহত্যা করতে হলে নিজের জায়গায় গিয়ে কোরো। এখন উঠে দয়া করে দুটি গেলো, আর আমাকে রেহাই দাও।
দৃশ্যটা আজও ভোলেনি বন্দনা। রমা মাসি চোখের জলে ভাসা মুখখানি তুলে বিকৃত গলায় বলল, খাব রেণুদি, না খেয়ে যাব কোথায়? চলো, যাচ্ছি।
নীচের খাওয়ার ঘরে মায়ের পিছু পিছু দুর্বল ধীর পায়ে নেমে গেল রমা মাসি। পিছনে চুপি চুপি বন্দনাও! একটু দূর থেকে, দরজার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে বন্দনা দেখল, রমা মাসি প্রাণপণে রুটি গিলবার চেষ্টা করছে, কাঁদছে, জলের গেলাস মুখে তুলছে। বিষম খাচ্ছে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল মাসির। দুই গাল ফুলে আছে রুটির দলায়। গিলতে পারছে না। তবু কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। শেষ অবধি পারল না। বেদম কাশি, বিষম, বমি সব একসঙ্গে ঘটল। মাসি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে চেয়ার-সমেত।
বন্দনা ভয়ে পালিয়ে এল।
পরে শুনেছে, মা ওই অবস্থায় মাসিকে রুটি বেলার বেলন দিয়ে বেদম মেরেছিল। ফুলুদির সামনে। ফুলুদিই পরে বলে, ওভাবে মারা ঠিক হয়নি মায়ের। ওভাবে কেউ মারে?
রমা মাসি অবশ্য মরেনি। শব্দ পেয়ে বাদুর দৌড়ে এসে মাসিকে তুলল। চোখেমুখে জল দিল। আঙুল দিয়ে মুখ থেকে রুটির দলা বের করল। তারপর ধরে ধরে দোতলায় এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। শূন্য দৃষ্টি কাকে বলে সেই ধন দেখেছিল বন্দনা। মাসি শুয়ে আছে খাটে। নিস্পন্দ। শুধু চোখ দুটি খোলা। সেই চোখে পলকও পড়ছে না, অথচ কিছুই যেন দেখতেও পাচ্ছে না।
আজও সেইসব দিনের কথা ভাবলে রমা মাসির জন্য কষ্ট হয় বন্দনার। অপরাধ যতই হোক, শাস্তি দেখতে কারই বা ভাল লাগে!
বাবা উঠল অনেক বেলায়। চোখ মুখ ফোলা, কেমন, উদভ্রান্ত চেহারা। ঘুম থেকে উঠেই তাকে ডাকল বাবা, বন্দনা মা, কোথায় তুমি?
বন্দনা ছুটে গিয়েছিল, এই তো বাপি।
তার বাবা চারদিকে পাগলের মতো চেয়ে দেখছিল। বলল, আমার কেমন লাগছে। একটু জল দেবে?
রাতে কেউ খাটের পাশে টুলে কাল জল রাখেনি। বন্দনা জল এনে দিতেই বাবা মস্ত কাঁসার গেলসটা প্রায় এক চুমুকে খালি করে দিয়ে বলল, আমার কি জ্বর? গায়ে হাত দিয়ে দেখ তো!
গায়ে হাত দিয়ে বন্দনা চমকে গেল। বাবার খুব জ্বর। বলল, হ্যাঁ বাপি।
আমার খুব শীত করছে।
তা হলে শোও বাপি, আমি গায়ে ঢাকা দিয়ে দিই।
না না। আমাকে এখনই স্নান করতে হবে।
জ্বর-গায়ে স্নান করবে?
হ্যাঁ মা। আমার গা বড় ঘিন ঘিন করছে।
তা হলে যে তোমার জ্বর আরও বাড়বে।
না, কিছু হবে না। এই বলে বাবা গিয়ে কলঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বন্দনা শুনতে পেল বাবা মগের পর মগ জল ঢালছে গায়ে। পাগলের মতো। দরজায় অনেকবার ধাক্কা দিল বন্দনা, বাবা, আর নয়।
বাবা শুনল না। অনেকক্ষণ বাদে যখন বাবা গা মুছে বেরিয়ে এল তখন শীতে চড়াইপাখির মতো কাঁপছে। হোট দুই হাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় নিয়ে এল বন্দনা। গায়ে ঢাকা দিল। বলল, কেন স্নান করলে বাবা? তোমার যে জ্বর!
বড্ড ঘিন ঘিন করে যে! বড্ড ঘিন ঘিন।
বিকেলে যখন জ্বর মাত্রাছাড়া হল তখন ডাক্তার দাশগুপ্ত এলেন। বললেন, এ তো সাঙ্ঘাতিক কনজেশন দেখছি বুকে! নিউমোনিয়ায় না দাঁড়িয়ে যায়।
নিউমোনিয়াই দাঁড়াল শেষ অবধি।
অন্য ঘরে তখন রমা মাসি দিনের পর দিন চুপ করে শুয়ে বসে থাকছিল। কেদার দত্ত টিকিট নিয়ে আর এল না। কয়েকদিন পর মাসিকে নীচের একটা এঁদো ঘরে চালান দিল মা। বলল, ওপরে এসো না। নীচেই থেকো। আর ঘরের দরজা আটকে রাখবে সব সময়ে।
মাসি নীরবে এই নিয়ম মেনে নিল।
মা একটা পোস্টকার্ড লিখল মধ্যপ্রদেশে।
কয়েকদিন বাদে রমা মাসির মায়ের কাছ থেকে জবাব এল মা রেণু, রমাকে নিয়ে কি তোদের খুব অসুবিধা হচ্ছে? রমা বড় শান্ত মেয়ে। তার পিসেমশাই ছুটি পেলেই গিয়ে নিয়ে আসবে। চিন্তা করিস না।
বাবার অসুখ সারল একদিন। কিন্তু সারল না বাড়ি থমথমে ভাবটা। কয়েকটি মাত্র প্রাণীর বাস, তবু একজন যেন অন্যদের থেকে কত দূর।