মায়ের গলার চড়া আওয়াজ শুনে রমা আরও একটু অবাক হল। বলল, তা তো বলিনি রেণুদি। ফিরে যাওয়ার কথা আগে বলোনি তো, হঠাৎ বললে বলে বললাম।
হঠাৎ আবার কী? দু মাস তো হয়ে গেছে। রোগও সেরেছে। এখন এখানে বসে থাকার মানেই হয় না। যা, সব গুছিয়ে-টুছিয়ে নে। তোর জামাইবাবু টিকিট কাটবার ব্যবস্থা করছে।
কার সঙ্গে যাব?
বাহাদুর তোকে পৌঁছে দিয়ে দেশে যাবে।
বাহাদুর! বলে চুপ করে রইল রমা।
বাহাদুর পুরনো বিশ্বাসী লোক। তার ওপর ভরসা করা যায়
আমি থাকলাম বলে তোমাদের বুঝি অসুবিধে হল রেণুদি?
তা সুবিধে-অসুবিধে তো আছেই।
রমা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে সাদা-হয়ে-যাওয়া ঠোঁটে একটু হাসল। বলল, কাল রাতে আমার খুব জ্বর এসেছে রেণুদি। আমার শরীরটা আজ একটুও ভাল নেই। তুমি আজই যেতে বলছ না তো!
কত জ্বর তোর?
মাপিনি। তবে কাঁপুনি দিয়ে মাঝরাতে জ্বর এল। অনেক জ্বর।
ঠিক আছে। ডাক্তার এসে দেখুক।
ডাক্তার লাগবে না। এরকম জ্বর আমার মাঝে মাঝে হয়। আমার তো পচা শরীর, ঠাণ্ডা লাগলেই বিছানা নিতে হয়। একটু শুয়ে থাকলেই হবে। তুমি ভেবো না, আমি ঠিক গুছিয়ে নেব।
মা গম্ভীর মুখ করে বলল, না, ডাক্তার আসবে। তুই ঘরে যা। আমি ডাক্তার ডেকে পাঠাচ্ছি।
এ বাড়ির পুরনো ডাক্তার সলিল দাশগুপ্ত এলেন। রুগি দেখে বললেন, টেম্পারেচার তো নেই দেহি। শরীরটা একটু উইক। টনসিল আছে নাকি?
রমা মাসি করুণ গলায় বলল, জ্বর কিন্তু এসেছিল ডাক্তারবাবু। বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যে করে বলছি না।
দাশগুপ্ত হেসে বললেন, অবিশ্বাস করছে কে? জ্বর আসতেই পারে। তবে এখন নেই।
মা কঠিন গলায় বলল, জ্বর নানারকম আছে। সব কি আর ধরা যায়!
রমা করুশ গলায় বার বার বলতে লাগল, না রেনুদি, বিশ্বাস করো, আমার সত্যিই জ্বর এসেছিল। অনেক জ্বর।
মা কঠিন গলায় বলল, ঠিক আছে। ওষুধ খাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তারবাবু একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে চলে গেলেন। মা ফিরে গেল রান্নাঘরে। বন্দনা পড়ার ঘরে। পড়ার ঘরের পাশেই রমা মাসির ঘর। মাঝখানের দরজাটা বন্ধু। পড়ার ঘর থেকে বন্দনা শুনতে পাচিল, রমা মাসি খুব কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, হেঁচকি তুলে।
বাড়িটা বড় থমথমে হয়ে গেল।
দুপুরে উদভ্রান্ত চেহারায় বাবা ফিরতেই মা বলল, কোথায় গিয়েছিলে?
কাজ ছিল।
কী কাজ?
ছিল।
রমার টিকিটের কী হল?
ব্যবস্থা করে এসেছি।
কবেকার টিকিট? কাকে কাটতে দিয়েছ?
কেদারকে।
কেদার দত্ত নামে বাবার এক বন্ধু আছে রেলে কাজ করে। তাদের টিকিট সে-ই কেটে দেয়।
মা জিজ্ঞেস করল, কবেকার টিকিট?
যবেকার পায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
মা আর কিছু বলল না। কিন্তু বাড়িটা থমথম করতে লাগল। স্কুল থেকে ফিরে বন্দনা দেখল, নিজের ঘরে শুয়ে আছে রমা মাসি। সারা দিন খায়নি। তার বাবা কোথায় ফের বেরিয়ে গেছে। বন্দনার বন্ধুর সংখ্যা বরাবরই কম। এ বাড়ির নানারকম বিধিনিষেধ থাকায় সে যখন-তখন বেরোতেও পারে না। তার একমাত্র স্বাধীনতা বাগান আর ছাদ। সেদিন সে একটু ঠাণ্ডা ভাত খেয়ে ছাদে উঠে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখল, পড়ন্ত শীতের শেষবেলায় পশ্চিম দিম্ভের আশ্চর্য বিষয় সূর্যাস্ত। মাথার ওপর মস্ত আকাশ জুড়ে নেমে আসছে আগ্রাসী অন্ধকার।
কী হয়েছে তা সে ভাল জানত না তখনও। নিষিদ্ধ সম্পর্ক সম্বন্ধে তার ধারণা স্পষ্ট হয়নি। শুধু বুঝতে পারছে রমা নাসি আর বাবাকে নিয়ে একটা কিছু ঘুলিয়ে পাকিয়ে উঠছে। কী হবে এখন? ভেবে একা একা কাদল বন্দনা। বাবাও সারা দিন খায়নি। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে!
বাবা ফিরল সন্ধে পার করে। গলা অবধি মদ খেয়ে এসেছে। চুর মাতাল। কোনও দিন জ্ঞানবয়সে বাবাকে মদ খেতে দেখেনি বনা! কী যে হয়েছিল সেদিন! মনে কষ্ট হলে কি মানুষ মদ খায়?
তবে তার বাবা চেঁচামেচি করেনি, অসংলগ্ন কথাও বলেনি। টলতে টলতে এল, উঠোনেই তিনবার পড়ে গেল দড়াম দড়াম করে। সিঁড়ি বেয়ে উঠল হামাগুড়ি দিয়ে। তাতেও পড়ে গেল। পরে বাহাদুর আর মদনকাকা এসে ধরে ভুলে বড় খাটে শুইয়ে দিল বাবাকে। তারপর বিছানা আর মেঝে ভাসিয়ে বমি করল বাবা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমোনোর আগে ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায়। শুধু একবার বলল, যদি গলায় দড়ি দেয় তা হলে কী হবে? সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে না হাজতে?
সেদিন তাকে বাবার কাছে শুতে দেয়নি মা। সে আর মাশুল বিলুর ঘরে। আলাদা খাটে বিলু। সে আর মা একসঙ্গে।
বন্দনার ঘুম আসছিল না ভাল করে। বার বার ছিঁড়ে যাচ্ছে ঘুম। তার মধ্যেই টের পেল, মা বার বার উঠে বারান্দায় যাচ্ছে। রমা মাসির ঘর থেকে গোঙানির মতো শব্দ আসছিল মাঝে মাঝে। মা বোধহয় কেন গোঙাচ্ছে দেখতে যাচ্ছিল। কিংবা বাবা ও ঘরে যায় কি না।
পরদিন সকালে বিলু তাকে বলল, এ বাড়িতে কী সব হচ্ছে রে দিদি?
বিলু কিছু জানে না। তার তত বাইরের জগৎ নিয়েই বেশি কাটে। বন্দনা গম্ভীর হয়ে বলে, কী আবার হবে? কিছু হয়নি।
বাবা নাকি কাল মদ খেয়ে এসেছে?
তোকে কে বলল?
আমি নীচের তলায় মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ছিলাম তো, নিজের চোখে দেখেছি। কী হচ্ছে রে? ফুলুদি যেন কী সব বলছিল। রমা মাসিকে নিয়ে নাকি কী সব গোলমাল হয়েছে।
ফুলুদি এ বাড়ির কাজের মেয়ে। ঠিকে। সেও পুরনো লোক। একটু বোকা হলেও খুব কাজের এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তাদের দুই ভাইবোনের ওপর সুযোগ পেলে খবরদারি করতে ছাড়ে না।