না মাসি, মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে নেই। ওঁদেরও নিশ্চয়ই তোমাকে ছেড়ে কষ্ট হচ্ছে!
কে জানে? কষ্ট কেন হবে? কষ্টের কী আছে?
নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে। তুমি বুঝতে পারছ না।
রমা তবু মাথা নেড়ে বলল, আমাদের সংসার যদি দেখতিস তা হলে ওকথা বলতিস না। আমরা পাঁচটা বোন ধুলোয় পড়ে বড় হয়েছি। আদর কে করবে বল! মা রোগা-ভাগা মানুষ, বাবা তো উদয়াস্ত ব্যস্ত। তার ওপর প্রায় রাত্রেই দেশি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফেরে। কী সব অসভ্য গালাগাল করে মাকে। আগে মারধরও করত। আমরাও বাবার হাতে অনেক মার খেয়েছি। এখন মারে না, কিন্তু গালাগাল করে। তুই যেমন সুন্দর বাড়িতে, সুন্দর সংসারে বড় হচ্ছিস, আমাদের ঠিক তার উল্টো।
তোমার বাবা মদ খায়?
খায়। দুঃখেই খায় হয়তো। অভাবকষ্টে মাথাটা ঠিক রাখতে পারে না। পাঁচটা মেয়ে এখন গলার কাঁটা। মদ খেলে সেই চাপা দুখ আর রাগ বেরিয়ে আসে।
তোমার তো তা হলে খুব কষ্ট মাসি।
সে কষ্টের কথা তুই ভাবতেও পারবি না। আমার একটুও ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় না।
তোমাদের পাঁচ বোনে ভাব নেই?
আছে। আমরা তো সমান দুঃখী, তাই আছে একটু, ঝগড়াও হয় মাঝে মাঝে।
রমার জন্য কষ্ট হওয়ার চেয়ে বন্দনার দুশ্চিন্তাই হয়েছিল বেশি। মাসি যে ফিরে যেতে চাইছে না। যদি ফিরে না যায় তা হলে তো এ বাড়িতে আরও অশান্তি দেখা দেবে।
দুদিন বাদে ফের গভীর রাতে পাশ ফিরতে গিয়ে বাবার স্পর্শ না পেয়ে জেগে গেল বন্দনা। তখন শুনল বারান্দায় মায়ে আর বাবায় কথা হচ্ছে।
মা বলল, তুমি মাঝরাতে উঠে কোথায় যাচ্ছিলে?
বাবা অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছিলাম মানে? ঘরে গরম লাগছে, ঘুম আসছে না। তাই একটু বারান্দায় এসেছি।
গরম লাগলে তো পাখা খুলে দেওয়া যায়, জানালা ফাঁক করে দেওয়া যায়, উঠে বারান্দায় আসার দরকার ছিল কি?
বন্দনার বাবা একজন কবির মতো মানুষ। উদাসীন, আনমনা। বাবা কখনও গুছিয়ে বলতে পারে না। সামান্য কারণেই ভীষণ ঘাবড়ে যায়। মায়ের কঠিন শীতল গলায় ওই প্রশ্নের জবাবে বাবা তোতলাতে লাগল, আমি তো একটু খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়ালাম, কী দোষ হল তাতে?
খোলা হাওয়ায় দাঁড়ানো না কী সে তুমিই জানো। কোনও দিন তো তোমাকে মাঝরাতে উঠতে দেখি না। গরম তো আগেও পড়ত। আজকাল হঠাৎ মুক্তবায়ুর দরকার বাড়ছে কেন?
তুমি কি কিছু একটা বলতে চাইছ?
চাইছি। তোমার মতলবটা কী?
আমার কোনও মতলব নেই। তুমি আমাকে এত অপমান কোরো না। আমার মরতে ইচ্ছে করছে।
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পুরুষমানুষকে যে বিশ্বাস করে সে বোকা, আমি ও পাপ বিদেয় করতে চাই। তুমি রমার টিকিট কেটেছ?
বাবা স্তিমিত গলায় বলল, শুধু টিকিট কাটলেই কি হয়? সঙ্গে কে যাবে? মধ্যপ্রদেশ অবধি একটা বয়সের মেয়ে কি একা যেতে পারে? আগে চলনদার ঠিক করতে হবে।
মা একটু চুপ করে থেকে বলে, বাহাদুর দেশে যেতে চাইছে। ও সঙ্গে যাক। রমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে দেশে চলে যাবে।
ঠিক আছে। বাহাদুরকে বলে রাজি করাও, আমি টিকিটের জোগাড় দেখছি।
কাল থেকে তুমি বন্দনাকে নিয়ে এ ঘরে থাকবে। আমি রাতে রমার ঘরে শোব। ও ঘরে একটা বাড়তি চৌকি আছে।
বাবা অসহায় গলায় বলল, তোমার যা খুশি করো। সামান্য বারান্দায় আসা নিয়ে যে এত কথা উঠতে পারে জানা ছিল না।
বারান্দায় আসা নিয়ে কথা উঠছে না। বারান্দার ওই কোণে একজন ঢলানি থাকেন। ভাবছি, বুজনে ইশারা ইঙ্গিত হয়ে ছিল কি না।
বাবা শুধু অনুতাপ ভরা গলায় বলল, ছিঃ ছিঃ!
ছিঃ ছিঃ তো আমার বলার কথা।
তুমি বলতে পারছ এসব কথা? তোমার মন সায় দিচ্ছে?
নইলে বলছি কী করে?
এতকাল আমার সঙ্গে ঘর করার পর আমাকে তুমি এই চিনলে?
ঘটনা ঘটলে তবে তো মানুষকে চেনা যায়! তোমাকে নতুন করে এই তো চিনছি। নিজের ওপর তোমার কোনও কন্ট্রোল নেই। তোমাকে ভূতে পেয়েছে।
আর বোলো না, আমার বড্ড গ্লানি হচ্ছে।
বাবা কি কেঁদে ফেলল? গলাটা কেঁপে হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে গেল। তার বাবা একজন কবির মতো মানুষ। বাস্তবজ্ঞানবর্জিত, দুর্বলচিত্ত, ব্যক্তিত্বহীন।
বড় কষ্ট হয়েছিল বন্দনার। উঠে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, তুমি কেঁদো না বাবা, তুমি কাঁদলে আমারও যে কান্না পায়।
তারপর মা আর বাবা এসে তার দু পাশে শুয়ে পড়ল। যেন দুটি ঠাণ্ডা পাথর তার দু দিকে। সে যে জেগে আছে তা বুঝতে না দেওয়ার জন্য মড়ার মতো পড়ে রইল বন্দনা। জলতেষ্টা পেয়েছিল, বাথরুম পেয়েছিল, কিন্তু সব চেপে রাখল সে।
পর দিন সকালটা খুব মনে আছে বন্দনার, একটা থমথমে গম্ভীর সকাল। বাবা ঘুম থেকে উঠেই কী একটা ছুতোয় বেরিয়ে গেছে। একটু বেলায় মা একতলার রান্নাঘর থেকে দোতলায় উঠে এল। তখন সামনের বারান্দায় একা চুপ করে বসে ছিল রমা। পাশেই পড়ার ঘরে বন্দনা। বই খুলে খারাপ মন নিয়ে বসে আছে। পড়বার ভান করছে, পড়ছে না। বিলুর সঙ্গে তার ঝগড়া লেগে যায়। বলে বিলুর পড়ার ঘর একতলায়। দোতলাটা সুতরাং নিরিবিলি।
মা বারান্দায় গিয়ে পিছন থেকে বলল, রমা, তুই সব গোছগাছ করে রাখিস। দু একদিনের মধ্যেই ফিরে যাবি।
রমা মাসি যেন চমকে উঠে পিছন ফিরে চেয়ে দিদিকে দেখল। মুখখানা ছাইরঙা হয়ে গেল যেন। অবক গলায় বলল, ফিরে যাব?
ফিরে যাবি না তো কী? এখানে কি পাকাপাকিভাবে থাকতে এসেছিস?