কবে কী হয়েছিল কে বলবে? এই প্রকাণ্ড বাড়ির আনাচে কানাচে কবে যে বাবার সঙ্গে রমা মাসির হৃদয় বিনিময় হল! বন্দনা অন্তত জানে না।
দুজনে অবশ্য ঠাট্টা-ইয়ার্কি হত খুব। খাওয়ার টেবিলে, বাগানে। মাঝে মাঝে সিনেমায় যাওয়া হত সবাই একসঙ্গে। যেমন সব হয়।
একদিন গভীর রাতে ঘুমচোখে বন্দনা শুনেছিল মা আর বাবাতে কথা হচ্ছে।
মা বলল, কথাটার জবাব দেবে? না কি?
একথার কি জবাব হয়?
তার মানে মনে পাপ আছে।
পাপের কথা বলছ কেন? তোমার মনেই পাপ আছে।
আমি কি ভুল দেখেছি?
ভুল ছাড়া কী? তোমাকে সন্দেহ বাইতে ধরেছে।
সন্দেহ?
সন্দেহ ছাড়া কী?
আমার চোখে তো ছানি পড়েনি! তুমি অন্ধকারে বারান্দায় ওর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলে। খুব ঘেঁসে। তখন আমার নীচের তলায় রান্নাঘরে থাকার কথা। বন্দনা মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ছিল। বিল ফেরেনি। ঠিক বলছি?
একবার তো বললে! শুনেছি।
তুমি তো ভাবনি যে, আমি এসে পড়ব!
এলে তো কী হল? আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, হাওয়া খাচ্ছিলাম। ও এসে পাশে দাঁড়াল। গল্প করছিলাম।
তা বলে অত ঘেঁসে?
তাতে কী? অন্ধকারে যত ঘেঁসে মনে হয়েছে ততটা নয়। তফাত ছিল। তুমি কি আমাকে চরিত্রহীন মনে করো?
আগে তো কখনও করিনি।
মেয়েদের ওইটেই দোষ। স্বামীদের অকারণে সন্দেহ করে। বাবা একটু হাসবার চেষ্টা করেছিল এসময়ে। হাসিটা ফোটেনি।
মা একটু চুপ করে থেকে বলল, ওকে আমি চিনি, ঢলানি মেয়ে। পুরুষ-চাটা। তা বলে তুমি তো আর সস্তা নও। হেসে উড়িয়ে দিয়ো না। তুমি কালই ওর ফেরত যাওয়ার টিকিট কিনে এনো। ওকে আর এখানে রাখব না।
তাই হবে।
সারা রাত বারবার ঘুম চটে গেল বন্দনার। বুকের মধ্যে একটা ভয়-ভয়, একটা ব্যথা, একটা অস্বস্তি। বাবা আর মায়ের মধ্যে ঝগড়াঝাটি খুব কম হয়। মা শান্ত ও সংসারমুখী মানুষ, বাবা উদাসীন ও অন্যমনস্ক। মা যদিও বা কখনও কখনও ঝগড়া করে বাবা একদমই নয়। ফলে ঝগড়া হয়, একতরফা হয়ে যায়।
সেই রাতে মা বাবার ওইসব কথাবার্তার পর কেউই এসে আর প্রকাণ্ড পালঙ্কের বিছানায় শুল না! মা আর বাবার মাঝখানে শোয় বন্দন-বাবার দিকে একটু বেশি ঘেঁসে। সেই রাতে বাকি রাতটুকু এই শুয়ে থাকল সে। একা লাগছিল, ফাঁকা লাগছিল, কান্না পাচ্ছিল। রমা মাসিকে মনে হচ্ছিল, রাক্ষুসি। কেন এল এবাড়িতে? না এলেই তো ভাল ছিল!
অথচ আশ্চর্য এই, সেই রাতের আগে অবধি রমা মাসির মতো এমন চমৎকার বন্ধু আর পায়নি বন্দনা। গয়ে, গানে, খুনসুটি আর হাসিতে তাদের দুজনের চমৎকার সময় কাটত। সকালে উঠেই সে গিয়ে পুবের ঘরে রমা মাসির বিছানায় ঢুকে যেত। ভোরবেলা শুয়ে শুয়েই কত গল্প হত। খুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টা দুজনে সব সময় লেগে লেগে থাকত।
রমা মাসির বুকের ভিতরে একটা সাঁই সাঁই শব্দ হত প্রায় সবসময়। কখনও মৃদু, কখনও জোরালো। শ্রীকালেও গলায় কটার। ঠাণ্ডা জল ছুঁতেই পারত না। পায়ে বারো মাস মোজা। মুখখানায় একটা করুণ ভাব থাকত সবসময়ে।
বিশু কবিরাজ চিকিৎসা শুরু করার পর রমা মাসির হাঁপের রোগ অনেকটা কমে গিয়েছিল। চেহারার উন্নতি হয়েছিল অনেক। রমা মাসির গানের গলাখানা ছিল চমৎকার। কিন্তু হাঁপানির জন্য গাইতে পারত না। টান কমে যাওয়ার পর এক একদিন গাইত। কী সুরেলা গলা
মা আর বাবাতে যে রাতে ওইসব কথা হল তার পর দিন সকালে বন্দনা রোজকার মতো মাসির কাছে গেল না। তার চোখে সেই সকালে ছিল অন্ধকার। মটকা মেরে অনেকক্ষণ পড়ে রইল বিছানায়। বেশ বেলা অবধি। কেউ তাকে ডাকতে এল না।
আটটার সময় এল রমা মাসি।
ওমা! তুই এখনও শুয়ে আছিস? কেন রে? শরীর খারাপ নাকি?
রমার করুণ মুখের দিকে চেয়ে সে কিছুতেই ভাবতে পারল না যে, এ একটা রাক্ষুসি। রমা মাসির অসহায় মুখখন দেখলেই এমন মায়া হয়!
রমা মাসি তার পাশটিতে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ওঠ। অনেক বেলা হয়েছে।
মাসি, তুমি করে ফিরে যাবে?
রমা একটু চুপ করে থেকে বলল, এবার যাব। অনেকটা তো ভাল হয়ে গেছি। কেন বল তো! আমি গেলে তোর মন খারাপ লাগবে, না?
হ্যাঁ মাসি। তবে তোমারও তো মাবাবার জন্য মন কেমন করে, তাই না?
মাসি আবার একটু চুপ করে থেকে বলে, করে।
আমি তো মাবাবা ছাড়া থাকতেই পারি না।
রমা মাসি করুণ একটু হেসে বলল, সবাই কি তোদের মতো সুখী? আমাদের কিন্তু তোদর মতো এত ভাব ভাবাসা নেই।
ওমা! কেন মাসি?
আমরা পাঁচ বোন, পাঁচটা গলগ্রহ। আমাদের আদর করবে কে?
যাঃ, কী যে বলো।
ঠিকই বলি। আমরা পাঁচ বোন কী করে হলাম জানিস? বাবা ছেলে-ছেলে করে পাগল, প্রত্যেকবার যেতে চায় আর আমরা একটা একটা করে মেয়ে জন্মাতে থাকি। আমরা হলাম বাবার পটটা হতাশা।
সেই সকালে রমা মাসিকে মন থেকে অপছন্দ করার চেষ্টা করেছিল বন্দনা, কিন্তু ঘেন্নাটা আসতে চাইছিল না।
রমা নাসি তদগত হয়ে জানালার বাইরের দিকে চেয়ে ছলছল চোখ করে বলল, তোদের বাড়িতে কী ভাল আছি বল তো। আমাদের বাড়িতে তো এত আদর নেই। বাবার সামান্য চাকরি। ঘোট বাসা। আমরা পাঁচ-পাঁচটা বোন বেড়ে উঠছি। না রে, তোদর মতো আমরা নই। আমাদের মধ্যে ভাবাসা খুব কম। আমার তো একটুও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।
ব্যগ্র হয়ে বন্দনা বলল, না না মাসি, ওরকম বোলো না। তুমি ফিরে যাও।
রমা হেসে ফেলল। বলল, তাড়াতে চাস নাকি?