দাদাকেও টেনেছিল। প্রদীপ একটু বোকা ছিল। আর খুব গোঁয়ার। পঞ্চানন সেনের ছেলে বাবু ছিল ওর খুব কাছের লোক। পঞ্চানন সেরে মেলা টাকা আর মেলা ছেলেপুলে। বাবু বোধহয় আর সাত নম্বর সন্তান। বেশ ভদ্র চেহারা, কথাবার্তায় প্রবল আত্মবিশ্বাস, কিন্তু অহঙ্কার নেই। বাবু মানুষের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করে না। কিন্তু প্রয়োজন হলে রুদ্রমূর্তি ধরে তাণ্ডব লাগিয়ে দিতে পারে। বাবু ছিল প্রদীপের হিরো। ছেলেবেলা থেকে সে বাবুর সাগরেদি করে এসেছে।
বাবুর হিরো হলেন সুবিমল স্যার। তাঁর কথায় গোটা এলাকা ওঠে বসে। সুবিমল স্যার একেবারে সাধুসন্নিসির মতো মানুষ। তাঁর ধ্যানজ্ঞান হল পার্টি। বিয়ে করেননি, পৈতৃক বাড়ির বাইরের দিককার একখানা ঘোট ঘরে ছোট্ট একটা তক্তপোশে দিনরাত বসে থাকেন। সামনে বিড়ির বান্ডিল, দেশলাই আর ছাই বা বিড়ির টুকরো ফেলার জন্য মাটির ভাঁড়। গাদা গাদা কাগজপত্র চারদিকে ছড়ানো। ঘরে সর্বদাই পার্টির ছেলে ছোকরাদের ভিড়। ঘড়ি ঘড়ি চা আসে সেখানে। দু বেলা দু মুঠো খাওয়া ছাড়া ভিতর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। অথচ ভিতর বাড়িতে ভরভরন্ত সংসার। দুই ভাই, ভাইয়ের বউ এবং ছেলেমেয়েরা, সুবিমল স্যারের মা এখনও বেঁচে! সুবিমল স্যারও হিরো, তবে অন্য ধরনের। তাঁর ত্যাগ, তিতিক্ষা, সরল জীবন এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি–এরও কি ভক্ত নেই? সুবিমল স্যারের অনেক ভক্ত। তিনি কলেজের পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর। ক্লাস খুব কমই নেন। সবাই সমীহ করে চলে।
প্রদীপ বাবুর সঙ্গে সেখানে গিয়ে জুটল। যারা নেতা হতে পারে না তারা নেতাদের খিদমদগার হয়। প্রদীপ ছিল তাই। বোকা ছিল বলে তার পড়াশুনোয় উন্নতি হয়নি। রাজনীতিতেও নয়। সে পার্টির আদর্শ ভাল করে বুঝতও না। সে শুধু ছিল বাবু আর সুবিমল স্যারের অন্ধ ভক্ত। ও বাড়িতেই পড়ে থাকত বেশির ভাগ সময়। চা এনে দিত, পোস্টার লিখত, ইস্তাহার বিলি করত আর বিপ্লব-বিপ্লব.করে মাথা গরম করত। ইলেকশন ক্যাম্পেনের সময় প্রদীপ রাত জেগে দেওয়ালে লিখছিল। নিদোষ কাজ। মাঝরাতে বিপক্ষের ছেলেরা এসে দেওয়ালের দখল নিয়ে ঝগড়া বাধায়। তারপর হাতাহাতি মারপিট। তার জের চলল দু-তিন দিন ধরে। দ্বিতীয় দিন রাতে সুবিমল স্যারের বাড়ি থেকে গভীর রাতে ফেরার সময় রথতলার মোড়ে তাদের বিপক্ষের দল ঘিরে ফেলল। গোলমালে অন্যগুলো পালাল, বোকা প্রদীপ পারল না। বুকে ছোরা খেয়ে মরে গেল। না, একজন পালায়নি। সে হল অতীশ। প্রদীপকে বাঁচাতে পারেনি বটে, কিন্তু ছিল।
মৃত্যু যে এত সহজ তা জানাই ছিল না বন্দনার। এই জানল। পরদিন ওই জায়গাটায় শহিদ বেদি তৈরি হল। লেখা হল কমরেড প্রদীপ চৌধুরি অমর রহে। পার্টির ছেলেরা এসে বাবাকে কত সান্ত্বনা দিল।
বাবার অফস্টাম্প উপড়ে গেল সেদিন। কবির মতো মানুষটির টানা টানা মায়াবী দুখানি চোখে পৃথিবীর সব স্বপ্নের রং মুছে গেল। এ যে কঠোর বাস্তব! এ যে রক্তে রাঙা ধুলোর ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা নিজের সন্তান। দিশেহারা বাবা কেবল যেটাছুটি করতে লাগল। ঘরে, বারান্দায়, রাস্তায়, এর ওর তার বাড়ি। এবার বন্দুক নিয়েও বেরিয়ে পড়েছিল। মা কয়েকদিনের জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। বন্দনা আর বিলু এত ভয় আর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল যে, তারা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল।
শহিদ বেদিটা আর নেই। ইট আর সিমেন্টের কাঁচা বেদি কবেই লোপাট হয়ে গেছে। প্রদীপ নেই, মানুষের মনে তার স্মৃতিও নেই। শুধু এ বাড়িতে কয়েকজন মানুষের কাছে প্রদীপ আজও বেঁচে আছে স্মৃতি হয়ে।
মাকে প্রথম দৃখটা দিয়ে গেল দাদা। এ বাড়িতে বন্দনার জন্মের পর প্রথম শোক। তার আশ্চর্য অভিঘাত এবং প্রতিক্রিয়া যেন ঝনঝন করে বাজত তাদের অস্তিত্বে।
প্রদীপের মৃত্যুর পর হীরেনবাবুর যাতায়াত শুরু হয়। এনকোয়ারি। এনকোয়ারির পর এনকোয়ারি। বুলু নামে একটা ছেলে প্রদীপকে মেরেছিল। সে ফেরার হয়ে যায়। মাঝখানে শুধু জেরার জবাব দিতে দিতে হাঁপিয়ে গেল তারা। বুলু ধরা পড়ল না। লোকে বলত, পুলিশ ওকে ধরবেই না। সাঁট আছে।
বুলু ছেলেটা যে কে তা আজও জানে না বন্দনা। শুনেছে, সে একটা বস্তিবাসী ছেলে। মস্তান। তার বাপের একটা তেলেভাজার দোকান আছে বাজারে। আসলে সেখানে দেশি মদের সঙ্গে খাওয়ার জন্য চাট তৈরি হয়। শুকুবাহাদুর মদ খায় বলে দোকান চেনে।
হীরেনবাবু বাপটাকে অ্যারেস্ট করেছিল। পরে ছেড়ে দেয়। তার তো কোনও দোষ ছিল না।
মাকে দ্বিতীয় দুখটা দিল বাবা। প্রদীপের মৃত্যুর দুবছর বাদে যখন শোকটা তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে যখন বাবার চোখে মায়াবী দৃষ্টিটা ফের ফিরে এসেছে এবং মা যখন সংসারের কাজে মন দিয়েছে ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। পৃথিবীতে কতই না আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।
রমা মাসি তার মায়ের আপন পিসতুতো বোন। অন্তত পনেরো ষোলো বছরের ছোট। দেখতে ভারী মিষ্টি। ডান চোখের নীচে একটা জরুল থাকায় মুখখানা যেন আরও সুন্দর দেখাত। রংটা চাপা ছিল বটে, কিন্তু রমাকে কেন যেন ওই রংই মানাত।
বিশু কবিরাজ হাঁপানির ওষুধ দেয়। খুব নাম। রমা মাসির হাঁপানি সারাতে মধ্যপ্রদেশ থেকে তার মা তাকে পাঠিয়েছিল এখানে। সেই সূত্রে রমা এ বাড়িতে দু মাস ছিল।