বাবা একটু ঘরকুনো মানুষ ছিল বলে তাদের কোথাও তেমন বেড়াতে যাওয়া হয়নি। শুধু ঘরকুনো নয়, ভীষণ ভিতুও। বাবা মেঘনাদ চৌধুরির নামটা যেমন বীরত্বব্যঞ্জক, স্বভাবটা ঠিক তার উল্টো। তবে বাবা একজন কবির মতো মানুষ। দুখানি মায়াবী চোখ দিয়ে অবিরল বিশ্রী পৃথিবীর ওপর নানা কল্পনার ছবি এঁকে যেত। বন্দনা ছিল বাবার প্রাণ। পৃথিবীতে এত ভালবাসা কি আর হয়? বন্দনা বাবাকে কত ভালবাসত?
বাবা জিজ্ঞেস করলে বন্দনা বলত, আকাশের মতো।
বাবার সঙ্গে খাওয়া, বাবার বুক ঘেঁসে শোওয়া, বাবার সঙ্গে সর্বক্ষণ। গায়ের গন্ধটা অবধি কী মিষ্টিই না লাগত! কত কী ভুলে যেত বাবা! গায়ে উল্টো গেঞ্জি, দু পায়ে দুরকম চটি, নুন আনতে বললে চিনি আনা। বাবার ভুলের গল্পের শেষ নেই। একজন কবির মতো মানুষ। অন্যমনস্ক, মাথায় চিন্তা এবং দুশ্চিন্তার বাসা, মুখে সবসময়ে একটা অপ্রস্তুত হাসি। বাবার ফুলের বাগানের শখ ছিল, আর গানের। কোনওটাই বাবা নিজে পারত না। কিন্তু বাবার সময়ে পিছনের বিস্তৃত বাগানে। হাজারো রকমের ফুলের চাষ হত, আর মাঝে মাঝে গায়ক গায়িকাকে ডেকে এনে ছোট্ট গানের আসর বসাত। বেশির ভাগই রবীন্দ্রসঙ্গীত।
বাবার কোলের কাছটিতে বসে মুগ্ধ হয়ে গান শুনতে শুনতেই একদিন তার ভিতরকার ঘুমন্ত সুর গুনগুন করে জেগে উঠেছিল।
আগের দিন সন্ধেবেলা বাবুপাড়ার মণিকাদি গান গেয়ে গেছেন, একটা গান কিছুতেই ছাড়ছিল না বন্দনাকে। রাতে ঘুমের মধ্যেও গানটা হয়েছিল তার বুকের মধ্যে। গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা সবচেয়ে ভাল লাগত, চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি, আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি….
পরদিন সকালে ইস্কুলে যাওয়ার আগে স্নান করবে বলে মাথায় তেল ঘসতে ঘসতে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে গাইছিল বন্দনা।
বাবা পিছন থেকে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, মাগো, তোমার গলায় যে সরস্বতী ভর করে আছেন!
সেদিনই মণিকাদির কাছে নিয়ে গেল বাবা, মণিকা, তুমি ওকে শেখাও। মাত্র আট বছর বয়স, পারবে।
বন্দনা পেরেছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে স্কুলের ফাংশনের বাঁধা গায়িকা। নান। ছোটখাটো অনুষ্ঠানে ডাক আসতে লাগল। বাবা নিয়ে যেতে লাগল নানা জায়গায়। রেডিয়োর শিশুমহলে গেয়ে এল একবার।
সেই থেকে গানে গানে ভরে উঠতে লাগল জীবন। গানের হ্যাপাও ছিল কম নয়। তেরো বছর বয়সেই বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল মধুবাবুর বাড়ি থেকে। ছেলে ডাক্তারি পড়ে। প্রেমপত্র আসতে লাগল অনেক। রাস্তায়-ঘাটে ছেলেদের চোখ তাকে গিলে খেতে লাগল। সে এমন কিছু সুন্দরী। নয়, তবুও। সে এদের কারও প্রেমে পড়েনি কখনও। কিন্তু কেন যে একজনের কথা ভাবলেই আজও তার ভিতরটা আলো হয়ে যায়। অথচ সে তো গরিব এক পুরুতের ছেলে। তার বেশি কিছু নয়। শিশুকালে সে একবার পুতুলের বিয়ের নেমন্তন্নে ডেকে অতীশকে বলেছিল, তোমার সঙ্গেই তো আমার বিয়ে হবে, না অতীশদা?
অতীশ জিভ কেটে বলেছিল, তাই হয় খুকি? তোমরা আমাদের অন্নদাতা। মনিব। প্রে
মপত্র পেলেই ছুট্টে এসে চিঠিটা বাবাকে দিত বন্দনা, দেখ বাবা কী সব লিখেছে!
দু-একটা চিঠিতে অসভ্য কথা থাকত বটে, কিন্তু বেশির ভাগই ছিল আবেগের কথায় ভরা। আবেগের চোটে বানানের ঠিক থাকত না, বাক্যেও নানা গণ্ডগোল থেকে যেত। বাবা আবার সেগুলো লাল কালিতে কারেকশন করে নিজের কাছে রেখে দিত।
সবচেয়ে ভাল চিঠিটা লিখেছিল বিকু। তাতে ইংরিজিতে একটা কথা লেখা ছিল, লাভার্স অ্যাট ফার্স্ট সাইট, ইন লাভ ফরএভার। পরে বন্দনা জানতে পেরেছে ওটা ফ্রাঙ্ক সিনাট্রার একটা বিখ্যাত গানের লাইন।
এইসব চিঠিপত্র নিয়ে বাবার সঙ্গে তার আলোচনা এবং হাসাহাসি হত। বাবা বলত আমার তিনটে স্টাম্প। তিনটেকেই গার্ড দিয়ে খেলতে হয়। তুই হচ্ছিস আমার মিডল স্টাম্প। সবচেয়ে ইস্পট্যান্ট।
মিডল স্টাম্পই বটে। দাদা আর ভাইয়ের মাঝখানে সে। তার ওপর সে আবার মেয়ে। বাবার চোখের মণি। বুকের ধন।
সন্ধেবেলা ঘুমিয়ে পড়া ছিল তার দোষ। হিল কেন, আজও আছে। কেউ তুলতে পারত না খাওয়ার সময়ে। বাবা এসে তুলত, বুকের ধন, বুকের ধন, ওঠো।
ঘুমচোখে তুলে বাবা নিজের হাতে গরাস মেখে খাইয়ে দিত। বাবার হাতে ছিল মায়া। সেই হাতের গরাসটা অবধি স্বাদে ভরে থাকত।
কোম্পানির কাগজ, শেয়ার আর ডিভিডেন্ড এসব কথা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে বন্দনা। আসলে এই তিনটে শব্দ থেকেই তাদের ভাতকাপড়ের জোগাড় হত। মেঘনাদ চৌধুরীর কোম্পানির কাগজ ছিল। অর্থাৎ শেয়ার। আর ফাটকা খেলার নেশাও ছিল। চাকরি করেনি কখনও। আজও তাদের চলে ওই কোম্পানির কাগজে। অবস্থা খারাপ হয়ে আসছে আরও। আরও।
বিজু একবার বলেছিল, তোদের বাড়ির দেওয়ালগুলো অত মোটা মোটা কেন বল তো? শুনেছি রাজা জমিদারা আগের দিনে শক্রদের মেরে দেওয়ালে গেঁথে ফেলত। তাই নাকি?
বন্দনা খুব হেসেছিল।
ফচকে মেয়ে বিজু বলল, যদি তা না হয় তবে নিশ্চয়ই দেওয়ালের ভিতরে গুপ্তধন আছে।
আহ! তা যদি হত। দেওয়াল ভাবেই যদি ঝরঝর করে ঝরে পড়ত মোহর!
মায়ের কাছে আজকাল কিছু চায় না বশনা। চাইলেই মায়ের মুখখানা শুকিয়ে যায়। বন্দনা চায় না, কিন্তু বিলু চায়। ফুটবল খেলার বুট, সাইকেল, এয়ারগান, দামি কলম, প্যান্ট বা শার্ট। বিলু তো মায়ের মুখ লক করে না। তার তত সময় নেই। সে হুট করে আসে, হুট করে বেরিয়ে যায়। এখন বাইরের জগৎ তাকে অনেক বেশি টানে।