আগে পরান, পিছনে সে। একটু দুলকি চালে দ্রুত পায়ে হাঁটছে তারা। অনেকটা হোটার মতো। ধীরে ধীরে যত কোমল ও সুম বোধ সুপ্ত হয়ে যায়। একটা চেতনা আর জেদ কাজ করে শুধু।
শীতকাল, তবু স্টেশন অবধি আসতেই ঘামে জামা আর প্লান্ট ভিজে সপসপে হয়ে গেল।
পরান বস্তাটা নামিয়ে তার ওপর বসে বিড়ি ধরাতে যাচ্ছিল। অতীশ বলল, পরিশ্রমের পর ওসব খেতে নেই। বুকের বারোটা বাজবে।
আমাদের ওসব সয়ে গেছে।
নিজের বস্তার ওপর উদাসভাবে বসে থাকে অতীশ। আজকাল তার কিছু ভাল লাগে না। কিছু একটা হয়ে উঠতেও ইচ্ছে করে না। থানা থেকে যেদিন ছেড়ে দিল সেদিন অতীশ তার ভাঙা শরীর নিয়েও গিয়েছিল বিশুদের বাড়িতে। বিশুর মা দৌড়ে এসে তাকে দুহাতে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চিৎকার করে বলছিল, ও অতীশ, তুই তো সঙ্গে ছিলি! তুই তো মরলি না, আমার ছেলেটা মরল কেন রে?
বার বার ওই কথা, তুই তো মরলি না, তবে আমার ছেলেটা কেন মরল? কথাটা কানে বড় বাজে আজও। কান থেকে কথাটা কিছুতেই তাড়াতে পারে না অতীশ।
মার-খাওয়া, থ্যাঁতলানো একটা শরীর, সর্বাঙ্গে বীভৎস কালশিটে, কাটা ছেঁড়া নিয়ে চার দিনের দিন ডাক্তার অমল দত্তের কাছে গিয়েছিল সে। অমলদা তাকে দেখে অবিশ্বসে মাথা নেড়ে বলেছিল, এই শরীর নিয়ে তুই ঘুরে বেড়াচ্ছিস কী করে? তুই তো হসপিট্যাল কেস!
জ্বালা-ধরা দুই চোখে হঠাৎ জল,এল তার। বলল, তবু তো বেঁচে আছি।
তুই বেঁচেও আছিস কি? এভাবে ওপেন উভ নিয়ে ঘুরে বেড়ালে সেপটিক হয়ে মরবি যে! এক্স-রেটা করাস, গোড়ালিটা যা ফুলেছে, মনে হচ্ছে ফ্র্যাকচার।
ক্ষতগুলো ব্যান্ডেজ মেরে, টেটভ্যাক দিয়ে অমলদা একটা প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন, সব ব্যাপারে হিরো হতে চাস না, বুঝলি? ওষুধগুলো ঠিকমতো খাস। আর সোজা বাড়ি গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাক।
একটু হাসল অতীশ। তার আবার বাড়ি, আবার বিছনা। ঘরে তার জায়গাই হয় না। ইফুলবাড়ির বারান্দায় সে শোয়। কিন্তু ডাক্তারবাবুকে সেসব কথা জানানোর মানেই হয় না।
শরীর ছাড়া অস্তিত্ব নেই। আবার সেই শরীর যখন অকেজো, অশক্ত হয়ে পড়ে তখন হয়ে ওঠে মস্ত ভারী একটা বোঝার মতো। আহত, থ্যাঁতলানো শরীরটা টেনে টেনে তবু দুদিন উদভ্রান্তের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়াল অতীশ। শরীরের ভার আর এক অক্ষম রাগ তাকে এমন তিরিকি করে তুলেছিল যে, বাড়ির লোক অবধি তার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পায়নি।
পাঁচ পাঁচটা নির্লজ্জ শহিদ বেদি তৈরি হল পাড়ায়। পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদে শহরে বন্ধ হল একদিন। তাতে যে মানুষের কী উপকার হল তা কে জানে! সু মানুষ এরকমই সব অর্থহীন কাজ করে।
একটা ডাউন গাড়ি গেল। পান বিড়িটা ফেলে দিয়ে বলল, আজ আপ গাড়িটা লেট করছে।
অতীশ শুধু বলল, হু।
কী ভাবছেন এত বসে বসে?
কত কথা ভাবি।
ডাউন গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হয়ে গেল। আপ গাড়ির জন্য দু-চারজন লোক বসে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য অস্তে যাচ্ছে চষা মাঠের ওদিকটায়। বড় খুনখারাপি রং হয়েছে। আকাশে। ঠাণ্ডা উত্তরে হাওয়া লেগে হঠাৎ ঘামে ভেজা শরীরে একটু শীত করে উঠল অতীশের।
মাথার ওপরে জ্যোৎস্না আর চারদিকে বারুদের গন্ধ, বোমা ফাটছে গুলি চলছে, আর ছাদ থেকে ঝুঁকে বন্দনা বলছে, আমি মরলে তোমার কী? তুমি বিচ্ছিরি লোক। বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি লোক! দৃশ্যটা এত ঘটনাবলির ভিতর থেকে যেন আলাদা হয়ে বড় মনকে উদাস করে দেয়। একদিন তেমাথার কমল স্টোর্সের কাছে সকালের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল অতীশ, একটা রিক্সায় বন্দনা কলেজে যাচ্ছিল। গায়ে একটা কমলা রঙের শাল জড়ানো, মুখখানা পাণ্ডুর, চোখ দুখানা বিষণ্ণতায় ভরা। যেন মানুষ নয়। যেন খুব ফিনফিনে খুব নরম জিনিস দিয়ে তৈরি একটা পুতুল। কী সুন্দর। তাকে দেখতে পায়নি, ভারী আনমনা ছিল। রিক্সাটি যখন দূরে চলে যাচ্ছে তখন অতীশ বিড়বিড় করে বলেছিল, তাই কি হয় খুকি? তাই কি হয়? তুমি হলে আমাদের মনিব, অন্নদাতা।
একটা বিষণ্ণ ঘণ্টির শব্দ চারদিকটাকে মথিত করতে থাকে হঠাৎ। পরাণ বলল, গাড়ি আসছে।
দিন পাঁচ-ছয় আগে একদিন রাতে বাড়ি ফিরতেই মা বলল, কাবাবু ফিরেছে, জানিস?
অতীশ অবাক হয়ে বলে, সে কী?
কী রোগা হয়ে গেছেন, চেনা যায় না। সঙ্গে ছোট বউ আর ছেলেও এসেছে। এখন এখানেই থাকবে।
একসঙ্গে?
তাই তো শুনছি। বড় গিন্নির সঙ্গে নাকি রফা হয়েছে। খবর পেয়ে তোর বাবা গিয়েছিল দেখা করতে। কতবাবুর বলে কী হাউহাউ কান্না। অনেক দিন বাদে নিজের বাড়িতে ফিরে নিজেকে সামলাতে পারছেন না। ছোট বউটা নাকি বড় গিমির ভয়ে একতলার সিঁড়িতে ছেলে কোলে করে বসে ছিল। বড় গিন্নির আপন পিসতুতো বোন হলে কী হয়, ছেড়ে কথা কওয়ার মানুষ বড় গিন্নি নয়। কদিন পরেই লাগবে।
বড়দি সেলাই করতে করতে বসল, তার ওপর আবার বুড়ো বয়সে ছেলে হয়েছে, ই। কত লোক আসছে রঙ্গ দেখতে। কী লজা, কী ঘেন্না বাব্বা।
ফাঁকা ট্রেনে বসে পরান আবার বিড়ি ধরিয়ে বলল, আজ যে খুব ভাবিত দেখছি আপনাকে। বলি হলটা কী?
অতীশ একটু হাসল। কিছু বলল না। আজকাল সে ভাবে। আজকাল সে খুব ভাবে।
স্টেশনে আলুর বস্তাটা নামিয়ে রিক্সায় তুলল অতীশ। পরান বলল, আলুর ব্যবসাই যদি করবেন তো বড় করে করুন। আমাদের মতো ছোট ব্যাপারি হয়ে থাকলে আর কপয়সা হবে। তারকেশ্বর, বাঁকড়ো, বর্ধমানের দিকে চলে যান, ট্রাক ভর্তি মাল নিয়ে আসুন, পকেটে টাকা ঝনঝন করবে।