বন্দনা হঠাৎ নিজের অজান্তেই অনুচ্চ স্বরে ডাকল, বাবা! একটু দাঁড়াও।
বাবা ভাল শুনতে পায়নি। যেতে যেতেই আর একবার মুখটা ফেরাল, তাকাল। তারপর ভুল শুনেছে মনে করে চলে যাচ্ছিল।
বন্দনা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল নীচে। তারপর ছুট-পায়ে গিয়ে দেউড়ির কাছে মানুষটার পথ আটকে দাঁড়াল। কোথায় যাচ্ছ তুমি এই রোদে? না খেয়ে? বলতে বলতে বহু কালের সমস্ত কান্না, জমে থাকা যত দুখ উথাল-পাথাল হয়ে উঠে এল তার বুক থেকে।
৬. এক অফুরান মাঠ
০৬.
পরান বলল, পারবেন?
পারব। পারতেই হবে।
সামনে এক অফুরান মাঠ। এবড়ো খেবড়ো চষা জমি। স্টেশন যে কত দূর! একমাস হয়ে গেছে, তবু অতীশের সর্বাঙ্গ আজও ব্যথিয়ে আছে। পুলিশ তার প্রত্যেকটা জয়েন্ট ভেঙে দিতে চেয়েছিল। কনুই, হাঁটু, মেরুদণ্ডের তলার দিকটা। মারতে মারতে যেন নেশা ধরে গিয়েছিল ওদের। তবু চেঁচায়নি অতীশ। একটুও যন্ত্রণার শব্দ বেরোয়নি মুখ দিয়ে। কেবল দৃশ্যটা মনে পড়ছিল। হাবু মণ্ডলের ঘরের পাশে সে আর বিশু দাঁড়িয়ে। রাত তখন সোয়া একটা হবে। বোমবাজির শেষ খেলটা খেলছিল বাবু আর ল্যাংড়ার দল। বড় বাড়ির দুধারের গলি দিয়ে বাবুর দল ঢুকে আসছিল। ল্যাংড়া লিড দিচ্ছিল বস্তির দু কোনা আটকে। কার জিত, কার হার তখনও বোঝ যাচ্ছিল না। আচমকা একটা চিৎকার শোনা গিয়েছিল, রিট্রিট!
ওই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে গলির দুধার থেকে বাবুর দলের ছেলেরা পিছিয়ে যেতে লাগল। তারপর হাওয়া হয়ে গেল।
বিশু চাপা গলায় বলল, এর মানে কী জানো তো গুরু? পুলিশ নামছে।
প্রথমে কয়েকটা টিয়ার গ্যাসের শেল এসে পড়ল গলির মধ্যে। তার পিছনে বুটের আওয়াজ। ল্যাংড়ার দলের ঝানু ছেলেরা চটপট বেরিয়ে এসে টিয়ার গ্যাসের শেলগুলো পটাপট বড় বাড়ির দেয়ালের ওধারে ফেলে দিল। তারপর গা-ঢাকা দিল। তারপর আড়াল থেকে মাঝে মাঝে ছুটে বেরিয়ে এসেই বোমা মেরে পালিয়ে যাচ্ছিল অলিগলির মধ্যে। পুলিশের সঙ্গে এরকম লুকোচুরি খেলার অভ্যাস এদের আছে।
পুলিশ ঢুকছিল দুধার দিয়েই। কিছু এল বড় বাড়ির ভিতর দিয়ে ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে গলে। এখনও ফায়ারিং অর্ডার দেওয়া হয়নি। তবু বিশু বলল, চলো গুরু, সরে পড়া যাক।
হাবু মণ্ডলের পাশের গলিতে ঢুকে তারা নিশ্চিন্তেই এগোচ্ছিল। কোনও বিপদ ছিল না।
আচমকাই একজন সাব ইন্সপেক্টর আর কনস্টেবল ঢুকে এল গলিতে। কিছু বোঝাই গেল না। দুম করে একটা শব্দ হতেই বিশু যেন ছিটকে শুন্যে উঠে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ এক অসহনীয় ছটফটানি। তারপর নিথরও। অতীশ আমূল বিস্ময়ে তার জীবনের দ্বিতীয় মৃত্যু-দৃশ্যটা দেখল। কিন্তু এবার আর সেই স্তম্ভন ছিল না, সেই ভয়টাও নয়। একটা পাগলা রাগে ক্ষিপ্তের মতো সে গলির মুখে ছুটে গেল। সাব ইন্সপেক্টরের হাতে খোলা রিভলভার, কনস্টেবলের হাতে রাইফেল। তাকে ছুঁড়ে দিতে পারত।
কেন মারলেন কেন মারলেন? কী করেছে ও? কেন গুলি করলেন? বলতে বলতে সে কনস্টেবলটার ওপরে গিয়ে পড়েছিল। একটা লাথি মেরে কনস্টেবলটাকে ফেলে দিয়ে রাইফেলটা কেড়ে নিতে যাচ্ছিল সে।
সাব ইন্সপেক্টর কমল রায় গৌরাঙ্গর দাদা। চেনা লোক। শুধু তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বলেছিল, কী করছ? যাও বাড়ি যাও। গো হোম!
কিন্তু ততক্ষণে বাহিনীটা এসে গেছে। কমল রায় চিৎকার করে তাদের আটকানোর একটা চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু তখন আশেপাশে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলছে ল্যাংড়ার দল। কমল রায় অন্য দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। আর তখন পুলিশের বুট আর রাইফেলের কুঁদেয় পাট পাট হয়ে গেল অতীশ। তাকে থানায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয় অর্ধচেতন অবস্থায়। লক আপে তার প্রবল ত্বর এসেছিল।
তিন দিন পর হীরেনবাবু তাকে বললেন, ওরে বাবা, পুলিশ কি লোকের নাম-ঠিকানা জেনে তবে গুলি চালাবে? পুলিশকে গুলি চালাতে হয় অন্ধের মতো। টু হম ইট মে কনসার্ন। বুঝেছ? তোমার বন্ধু মারা গেছে, কিন্তু ইচ্ছে করে তো আর মারেনি বাবা। তুমি একজন স্পোর্টসম্যান, জেলার সাম্পিয়ন। তোমার এগেনস্টে কেস দিচ্ছি না। বাড়ি যাও।
রিক্ত অবসন্ন অতীশ টলতে টলতে বাড়ি ফিরে এল। শরীরের ব্যথা নয়, তার মন-জুড়ে এক বিষের জ্বালা। বিশু নিরীহ ছিল, বিশু ছিল পাড়ার গেজেট, তেমন কোনও দোষও ছিল না ওর। গত একমাস ধরে ক্ষণে ক্ষণে শুধু বিশুর কথা মনে পড়ে।
পরান গাছতলায় বসে বিড়ি টেনে নিচ্ছিল। বলল, কেন যে এত কষ্ট করছেন! দুদিন পর তো কলকাতাতেই চলে যাবেন। সেখানে চাকরি বাকরি করবেন, ভাল থাকবেন, ভদ্রলোক বনে যাবেন। তবে আর এ কষ্টটা করা কেন?
অতীশ দূরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আমি সব কিছু পারতে চাই। বুঝলে!
আপনি শক্ত লোক। পুলিশের ওরকম মার খেলে অন্যে তিন মাস হাসপাতালে পড়ে থাকত। চলুন, গাড়ির সময় হয়ে আসছে। রাস্তা এখনও অনেক।
চল্লিশ কেজি নতুন আলুর বস্তাটা গাছের গোড়ায় দাঁড় করানো। অতীশ উঠল। তারপর বস্তাটা জাপটে কাঁধে তুলে ফেলল। তার পর দুহাতে একটা সাপটা টানে মাথায়।
সাবাস! বলে বাহবা দিল পরান।
পরানের কাছেই শেখা। অতীশ বলল, চলল।
ব্যথা বেদনার শরীর, মাথার ওপর গন্ধমাদনের ভার, সামনে অফুরান পথ। এই মেহনতের ভিতর দিয়েই একটা মোন হয় অতীশের। ক্লান্তিতে ঝিমঝিম করে শরীর, রগে রগে ছড়িয়ে পড়ে অবসন্নতা, অ ওই নিষ্পেষণের ভিতর দিয়েই নিজের ভিতরে আর একটা নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে সে।