নইলে উপায় কী?
আমি বলতে এসেছি, তুমি থাকো। আমি তো কাটিয়েই দিয়েছি আয়ু। বাকিটা কেটে যাবে।
তা কেন? কষ্ট করার তো দরকার নেই। রমাকে নিয়ে আসোনি?
না। সে আসতে বড় ভয় পায়।
ভয় কীসের? সে তো এখন সুয়োরানি। আমি দুয়ো।
বাবা একটা খুব বড়, বুক খালি করা শ্বাস ফেলে চুপ করে থাকল।
মা বলল, খাবে তো?
খাব! বলে বাবা যেন খুব অবাক হয়ে গেল।
মা বলল, ভাত খেয়ে এসেছ কি?
না।
দুপুরে এখানেই তো খাবে। আর কোথায় যাবে?
বাবা আর একটা খুব বড় শ্বাস ফেলে বলল, এ চেয়ারে বন্দনা বসে ছিল না?
হ্যাঁ।
আমাকে চিনতে পারেনি। না? কত তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেছি দেখ! অথচ এখন আমার চুয়ান্ন বছর বয়স! গত দু বছরে কী হয়ে গেল।
প্রেমের মাশুল দিতে হচ্ছে তো! বুড়ো বয়সের প্রেম তার হ্যাপা কি কম?
আমাকে তোমাদের বড্ড ঘেন্না হয়, না? আমার নিজেরই হয়, তোমাদের হবে না-ই বা কেন?
ঘেন্না পিত্তির কথা এখন থাক। চান করে ভাত খেয়ে একটু জিরোও। তারপর কথা হবে।
বাবা কথাটা কানেই তুলল না। বলল, স্টেশনে নামলাম, রিক্সা করে এত দূর এলাম, এর মধ্যে একটা লোকও আমাকে চিনতে পারেনি, জানো? স্টেশনের রেলবাবু না, রিক্সাওলা না, রাস্তার কেউ না। এমন কী মদনের সঙ্গে দেখা হল নীচে, সেও পারল না। মেয়েটা পর্যন্ত পারেনি। শুধু তুমিই দেখলাম, একবারে চিনলে।
আমার না চিনে উপায় আছে!
বিলু কি বাড়িতে নেই?
স্কুলে গেছে।
তবে বুঝি তার সঙ্গে দেখা হল না।
ওমা! কেন হবে না?
আমি চারটের গাড়িতে ফিরে যাব।
তা হলে এলে কেন?
দীপ্তির মুখে শুনলাম তুমি বাসা ভাড়া করে চলে যাবে বলে তোড়জোড় করছ। তাই ছুটে আসতে হল। তুমি ও কাজ কোরো না। তোমরাই থাকবে এখানে। বড় কষ্টে ছিলাম বলে তোমাকে ওরকম একটা অদ্ভুত চিঠি লিখেছিলাম। চিঠিটা পাঠিয়ে মনে হল, কাজটা ঠিক করিনি। সত্যিই তো, ওরকম কি হয়? তোমার যে তাতে অপমান হয় তা আমার মাথায় খেলেনি।
শুধু এইটুকু বলতে এলে?
হ্যাঁ। আর শেষবারের মতো তোমাদের একটু দেখে গেলাম। আর আসব না।
তোমার শরীরের যা অবস্থা দেখছি, ধকল সইবে তো! তেমন জরুরি কাজ না থাকলে আজ বরং থেকেই যাও। নিজের অধিকারেই থাকতে পারবে। এত বছর ঘর করলে আমার সঙ্গে একটা রাত এ বাড়িতে থাকলে আর কী ক্ষতি হবে?
থাকাটা কি ভাল দেখাবে রেণু?
ভাল দেখাবে কি না তা জানি না। তোমার শরীর ভাল দেখছি না বলে বলছি।
মেয়েটা বোধহয় চিনতে চাইল না, না? যাক রেণু, আমি বরং ফিরে যাই। বিলুটাকে দেখে গেলে হত। ওরা সব ভাল আছে তো!
আছে। যেমন রেখে গেছ তেমনই আছে।
আর একটু জল দাও। খেয়ে উঠে পড়ি। আড়াইটেয় একটা গাড়ি আছে। ধরতে পারলে সন্ধেবেলায় কলকাতায় পৌঁছে যাব।
আবার জল নিতে মা ঘরে এল। বন্দনা তখনও খাটে বসে। একদম পাথরের মতো।
একবার দেখা করবি না? একটু চোখের দেখা দেখতে এসেছে। যা না কাছে। শরীরের যা অবস্থা দেখছি, লক্ষণ ভাল নয়।
বন্দনা তবু নড়ল না।
বাবা জল খেল। তারপর আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। বোধহয় ক্লান্তি। বোধহয় প্রত্যাশা।
মা বলল, এ বাড়ির নাকি এখন অনেক দাম। মদন সেদিন হিসেব করে বলল, এক কোটি টাকার ওপর। শাওলরাম মাড়োয়ারি কুড়ি লাখ টাকা দিতে চাইছে। আর একটু বেশি দাম উঠলে বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ারই ইচ্ছে আমার। তুমি কী বলে?
তোমাকে তো ওকালতনামা দিয়েই রেখেছি। তোমার ইচ্ছে হলে বেচে দিয়ো। বাড়ি দিয়ে কী হবে?
চাও তো তোমাকে কিছু দেব। কষ্টে আছ।
এই প্রথম বাবা একটু হাসল। বলল, না, আর দরকার নেই।
দরকার নেই কেন? খুব নাকি অভাব!
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, সে একটা দিনই গেছে। খুব কষ্টের দিন। কিন্তু সয়েও যায় রেণু। এখন দেখছি, আমার আর অভাবটা তেমন বোধ হয় না। খিদে সহ্য হয়, রোগভোগ সহ্য হয়, অপমানও বেশ হজম করতে পারি। টাকা পয়সার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। না রেণু, বাড়ি বেচে টাকা-পয়সা হাতে রেখো। তোমার লাগবে।
মত দিচ্ছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ। মত দিয়েই রেখেছি। আসি গিয়ে?
দুটো সন্দেশ মুখে দিয়ে যাও।
বাবা উঠতে গিয়েও বসে পড়ল, দাও তা হলে।
সন্দেশ নিতে মা ঘরে এসে বন্দনার দিকে চেয়ে বলল, অন্তত সন্দেশটা নিজের হাতে দাও না বাবাকে। খুশি হবে।
ও লোকটা আমার বাবা নয় মা।
ও কী কথা? ছিঃ। ওরকম বলতে নেই।
আমার বাবা তো এরকম ছিল না মা।
মা ফ্রিজ থেকে সন্দেশ বের করে প্লেটে সাজাতে সাজাতে বলল, চিরদিন কি কারও সমান যায়? শুনেছিস তো অভাবে কষ্টে আছে। চেহারা ভেঙে গেছে, অকালবার্ধক্য এসেছে। তা বলে কি বাবা বলে স্বীকার করবি না?
বন্দনা গোঁ ধরে চুপ করে রইল।
বাবা সন্দেশ খেল। ফের জল খেল। বলল, কম খেলেই আজকাল ভাল থাকি। বুঝলে? এই যে দুটো সন্দেশ পেটে গেল এই-ই এক বেলার পক্ষে যথেষ্ট। উঠলাম, কী বলে?
কী আর বলব। বিলর তো ফিরতে দেরি আছে।
থাক থাক। না দেখাও ভাল। দেখলে মায়া বাড়ে কিনা।
মেয়ে সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।
থাক থাক। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। বড় হচ্ছে, একটা মতামত আছে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে বাবার খুব সময় লাগছিল। বন্দনা উঠে বারান্দায় এল। তারপর রেলিঙের ফাঁক দিয়ে চেয়ে রইল। একটু বাদেই বাবাকে দেখতে পেল সে, জীর্ণ শীর্ণ একজন মানুষ রোগা দুর্বল পায়ে ধীরে ধীরে উঠোনটা পেরোচ্ছে। পেরোতে পেরোতে একবার মুখ ফিরিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। এই তাকানোটা ওই মুখ ফেরানোটাই যেন তীব্র মোচড়ে বুক ভেঙে দিল বন্দনার। বাবা শেষবারের মতো চলে যাচ্ছে। আর আসবে না। উঠোনটা পেরোলেই তাদের সঙ্গে সব বন্ধন ছিঁড়ে যাবে। কেন মুখ ফেরাল বাবা? কেন?