বন্দনার জ্বর উঠল একশো চারে। বিকারের ঘোরে সে দেখছে ফুটফুটে শীতের সকালে তাদের শান্ত বাগানে গাছের ছায়ায় বসে সে পুতুল খেলছে। আজ পুতুলের বিয়ে। পুরুতমশাই কখন আসেন তার জন্য অপেক্ষা করছে সে।
মধ্যরাতে পুলিশের গাড়ি ঢুকল পাড়ায়। প্রথম টিয়ার গ্যাস। তারপর গুলি। বাড়ি ঘর ভরে গেল বারুদের গন্ধে।
ভোররাতে পিছনের বস্তির টিউবওয়েলের ধারে গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল ল্যাংড়া। পুলিশের শক্তিশালী রাইফেলের গুলি তার ঘাড় ভেঙে দিয়ে গেছে, বুকে মস্ত ফুটো দিয়ে রক্তের ফোয়ারা বেরিয়ে রাস্তা ভাসিয়ে দিল।
পরদিন নির্বিকার সূর্য ফের উঠল আকাশে। ততক্ষণে কোলাহল থেমে গেছে। মোট চারটে ডেডবডি তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। সকাল আটটার ট্রেন ধরবে বলে রওনা হয়ে গেল দীপ্তি। বাহাদুর তাকে রিক্সা ডেকে তুলে দিয়ে এসে বলল, ল্যাংড়া সাফ হয়ে গেছে মা। বাঁচা গেল।
মদনকাকা তার হোমিওপ্যাথির বাক্স নিয়ে এসে বন্দনার নাড়ি ধরে অনেকক্ষণ দেখে বলল এ যে খুব জ্বর!
হ্যাঁ। একশো চার। মা বলল।
নাড়ির অবস্থাও ভাল বুঝছি না। জ্বর বিকারে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। নিউমোনিয়া হওয়াও আশ্চর্য নয়। অ্যালোপ্যাথিই ভাল বউঠান। টাইফয়েডের পর শরীর কাঁচা থাকে।
ঘোরের মধ্যেই চোখ মেলে বন্দনা জিজ্ঞেস করল, ও কি চলে গেছে?
মা ঝুঁকে বলল, কে? কার কথা বলছিস? দীপ্তি? সে এই তো গেল। গিয়ে নাকি কলেজ করবে।
ডাক্তার ডেকো না মা, আমি আর ভাল হতে চাই না।
ও কী কথা? চুপ করে শুয়ে থাক।
কে মারা গেছে মা?
ও ল্যাংড়া।
আর?
আর কে জানি না। মোট চারজন।
উঃ।
কী হল?
খবর নাও কে মারা গেল আর।
ওসব ষণ্ডা-গুণ্ডাদের খবরে আমাদের কী দরকার? মরেছে বাঁচা গেছে।
উঃ মা, খবর নাও।
নিচ্ছি মা নিচ্ছি। ও বাহাদুর খবর নে তো কে কে মারা গেছে।
একটু বাদে মা এসে বলল, ল্যাংড়া, কুচো, ভোলা আর বিশু। কারা এরা তাও জানি না বাবা। তবে ভোলার মা বছরটাক আগে আমাদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত। বেচারা।
বন্দনা অস্ফুট গলায় বলল, কত শুব্ধ ছিলে তুমি, কত পবিত্র ছিলে! এঁটোকাঁটা হয়ে গেলে? আমার তো মোটে সতেরো বছর বয়স….এখনও কত দিন বাঁচতে হবে বলো তো! একা! কী ভীষণ একা।
মা বলল, মনটা ভাল নেই মা, আমাদের অতীশটাকে নাকি পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে!
বন্দনা কথাটা শুনতে পেল না। এক ঘুমঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে তখন।
মা বলল, পুলিশ নিয়ে তো বড় মারে। বোকা ছেলেটা। পুলিশের হাত থেকে নাকি বন্দুক কেড়ে নিতে গিয়েছিল।
চার দিন বাদে জ্বর ছাড়ল বন্দনার। একগাদা অ্যান্টিব্যয়োটিক খেয়ে শরীর আরও দুর্বল। আরও দুদিন বাদে হঠাৎ তাদের উঠোনে একটা রিক্সা এসে থামল ঠিক দুপুরবেলায়। একজন রোগা বুড়ো মানুষ একখানা হোট ব্যাগ হাতে খুব ধীরে ধীরে উপরে উঠে এল। গায়ে একটা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি, পরনে আধময়লা ধুতি, পায়ে হাওয়াই চটি। বারান্দায় তার চেয়ারে বসে ছিল বন্দনা। বুড়ো মানুষটিকে দোতলায় বিনা নোটিশে উঠে আসতে দেখে ভু কুঁচকে চেয়ে ছিল বন্দনা। কোনও আত্মীয় কি? চেনা?
মানুষটি তার দিকে কেমন এক বিমূঢ় চোখে চেয়ে ছিল। পলক পড়ছে না। একটাও কথা নেই। মুখে। পরাজিত বিধ্বস্ত একজন মানুষ।
বন্দনাও চেয়ে ছিল। গুড়গুড় গুড়গুড় করে পায়রা ডাকছে সিলিঙে। কেমন যেন করছে বুকের মধ্যে বন্দনার।
ঠিক এই সময়ে মা বেরিয়ে এসে বারান্দায় পা দিল। তারপর থমকে দাঁড়াল।
বুড়ো মানুষটি কাঁপছিল থরথর করে। হাত থেকে স্বলিত ব্যাগটা পড়ে গেল শানে।
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এলে তা হলে!
বুড়ো মানুষটি কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। একবার হাঁ করল। তারপর মুখ বুজে ফেলল। চোখের কোলে জল।
রেণু! বলে লোকটা আর পারল না। উবু হয়ে বসে পড়ল হঠাৎ। তারপর দুই হাতে মুখ ঢাকল। কাঁদল বোধহয়।
লোকটা কে তা বুঝতে পারে বন্দনা, কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। এই কি তার সেই বাবা, যে কিনা একজন কবির মতো মানুষ। শৌখিন আনমনা, কল্পনায় ডুবে থাকা। যে বাবা তাকে শিখিয়েছিল ঘোট ঘোট নানা জিনিসের মধ্যে রূপের সন্ধান। বাইরের দুনিয়া নরখাদক বাঘের মতো বাবাকে চিবিয়ে খেয়েছে। না, সবটা নয়। অর্ধেক ফেরত দিয়েছে বুঝি। প্রেতলোক থেকে যেন বাবার এই আগমন।
বন্দনা উঠল না, দৌড়ে গেল না, চিৎকার করল না আনন্দে, উদ্বেল হল না, শুধু চেয়ে রইল। দেখল, মা গিয়ে বাবাকে হাত ধরে তুলছে। বলল, এসো, বোসো। এ তোমারই বাড়িঘর। অত লজা পাচ্ছ কেন?
একটা ময়লা রুমাল পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে বাবা নাক আর চোখ মুছল। দ্বিতীয়বার বলল, রেণ।
বলো। কী বলবে?
বন্দনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরে চলে এল। এ কোন বাবাকে ফেরত দিল পৃথিবী? এ কেমন ফেরত পাওয়া? তার বুকের ভিতরে যে একটা পাথরের মতো স্তব্ধতা। মানুষ এত পাল্টে যায়।
ঘর থেকেই সে শুনতে পেল, মা বলছে, বোসো চেয়ারে। একটু জিরিয়ে নাও। কথা পরে হবে।
বাবা বসল। বলল, একটু জল দেবে?
মা জল নিতে ঘরে এসে বলল, বাবাকে প্রণাম করতে হয়। শত হলেও গুরুজন।
বন্দনা নড়ল না। চুপ করে বসে রইল। পাথর হয়ে।
জল খেয়ে বাবা আরও অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ওরকম চিঠি লিখলে কেন রেণ?
কেন, আমি কি খারাপ কিছু লিখেছি?
এ বাড়ি ছেড়ে তুমি কেন যাবে?