বন্দনা লজ্জা পেয়ে বলল, তুমি বাবাকে লিখছ, আমার কি সে চিঠি পড়া উচিত?
আহা, এ কি আর সেই চিঠি নাকি? এ চিঠির মধ্যে গোপন কথা আর কী থাকবে! পড়ে দেখ।
বন্দনা পড়ল। বেশি বড় চিঠি নয়। সম্বোধনে এখনও শ্রীচরণেষু লিখতে ভোলেনি মা। লিখেছে, তোমার বাড়িতে তুমি আসতে চাও আমি বারণ করার কে। বরং তোমার বাড়িতে আমিই তো অনধিকারীর মতো বাস করছি। আমি অন্য বাড়ি দেখছি, শিগগিরই ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে যাব। তোমার পথে আর কোনও কাঁটা থাকবে না। শাওলরাম মাড়োয়ারি এ বাড়ি কিনতে চাইছে। যদি তাকে বাড়ি বিক্রি করে তা হলে তোমার বড় দুটি ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু রেখো। ওদের তো ভবিষ্যৎ আছে।
চিঠিটা পড়তে পড়তে আবার চোখে জল এল বন্দনার। তার বাবা আর মায়ের মধ্যে কত ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, এখন কত দূরের হয়ে গেছে দুজনে। কেন যে এমন হয়?
ভুলভাল নেই তো।
না মা।
পাঠাব এ চিঠি?
পাঠাও।
পশ্চিমে দিগন্তে যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল আজ তখন ছাদের ওপর থেকে আকুল চোখে চেয়ে ছিল বন্দনা। তার মনে হচ্ছিল এই যে সূর্য অস্ত গেল আজ, আর উঠবে না কখনও। এর পর থেকে অনন্ত রাত্রি। শুধু অন্ধকার।
সন্ধের অন্ধকার যখন বিশাল পাখা মেলে অতিকায় এক কালো পাখির মতো নেমে আসছে, যখন গাছে গাছে পাখিদের তীব্র কলরব, পায়রারা ঝটপট করে নেমে আসছে ছাদে, ঠিক তখনই দু দুটো বোমা ফাটল পরপর।
আশ্চর্য এই-আজ ওই বিকট শব্দে একটুও চমকাল না বন্দনা। তার কোনও ভয় করল না। বরং ছাদ থেকে ঝুঁকে সে দেখার চেষ্টা করছিল, বোমা দুটো কোথায় ফাটল। বাগানের পিছন দিকে ধোঁয়া উঠছে নাকি?
পিছনের বাগানের একটা ঝোপ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল অবু। ওপরের দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, এই বন্দনা।
কী রে?
ঘরে যা। ল্যাংড়া অ্যাটাক করছে।
তার মানে?
ঘরে পালা।
বন্দনা একটু হাসল। বলল, এই তোর সাহস?
আমি যাচ্ছি খবর দিতে। ঘরে যা।
বন্দনা ঘরে গেল না। দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। দেওয়ালের ওপাশে গলিতে একটা দৌড়োদৌড়ি হচ্ছে। কে যেন ঢিল মেরে ল্যাম্প পোস্টের বালব ভেঙে দিল। অবু দৌড়ে চলে গেল সদরের দিকে। বাইরে থেকে আরও দুটো বোমা এসে পড়ল পিছনের বাগানে। বাইরে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, এই শালা, জানে মেরে দেব..
ধীরে, ধীরে সন্ধ্যার ভারী বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ছাদ থেকেই সে শুনতে পেল, তাদের দোতলায় দুড়দাড় করে জানালা দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মা চিৎকার করল, ওরে বাহাদুর! বিলু! বিলু কোথায়?
বিলু নীচের ঘরে আছে মা। পড়ছে।
আর বন্দনা?
দেখতে পাইনি।
সর্বনাশ! দেখ কোথায় গেল রোগা মেয়েটা!
দীপ্তিদি তার ঘর থেকে বেরোল বোধহয়। আতঙ্কিত গলায় বলল, এ জায়গায় তোমবা কেমন করে থাকো মামি! রোজ এরকম হয় নাকি?
আর বোলো না বাছা। কী যে ষন্ডামি-গুণ্ডামি শুরু হয়েছে আজকাল। ভয়ে মরি। বন্দনা কি তোমার ঘরে?
না তো মামি!
তা হলে কোথায় গেল?
ছাদে যায়নি তো?
বন্দনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন তাকে ঘরে যেতে হবে। ঘরে যেতে তার একটুও ইচ্ছে করছে না। জানালা দরজা বন্ধ করে দম চেপে থাকা তার পক্ষে এখন অসম্ভব। সে মরেই যাবে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। আজ কী তিথি জানে না সে। মস্ত চাঁদ দেখে মনে হয়, পূর্ণিমার কাছাকাছি। এখন কি ঘরে যেতে ইচ্ছে করে?
বাহাদুরের পায়ের শব্দ উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। বন্দনার আর ছেলেমানুষির বয়স নেই। তবু সে হঠাৎ ঘদের দক্ষিণ কোণে রাখা আলকাতরার পিপেটার পিছনে গিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ল। বাহাদুর ছাদে এসে চারদিকটা দেখে নিয়ে ফের দৌড়ে নীচে চলে গেল।
না মা, ছাদে তো দিদিমণি নেই!
ওমা! কী সব্বোনেশে কথা! মেয়েটা তা হলে গেল কোথায়?
দীপ্তি বলল, অমন অস্থির হোয়ো না মামি, আমি দেখছি। কোনও বান্ধবীর বাড়িতে যায়নি তো!
আমাকে না বলে তো কোথাও যায় না!
পিপের আড়াল থেকে উঠে রেলিঙে ফের ভর দিয়ে দাঁড়ায় বন্দনা। শালটা আনেনি। তার শীত করছে। ঠাণ্ডা লাগবে কি? লাগুক! তার একটুও আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
শাওলরাম মাড়োয়ারি এ বাড়ির দাম দিতে চেয়েছে চৌদ্দ লাখ টাকা। চৌদ্দ লাখ শুনে মা সে কী খুশি! শাওলরামের সামনেই বলে ফেলল, আমি রাজি আছি শাওলরামজি। আপনি ব্যবস্থা করুন। উনি পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি আমাকে দিয়ে রেখেছেন।
কথাটা সত্যি। বাবা চলে যাওয়ার পর তার খোলা দেরাজে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিটা পাওয়া গিয়েছিল। তার মায়ের বা তাদের যেন কষ্ট না হয় তার জন্য তার ভাল বাবা সর্বই প্রায় সঁপে দিয়ে গিয়েছিল মায়ের হাতে।
বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা আগেই হয়ে যেত। কিন্তু মদনকাকা শাওলরামের দর শুনে মাকে এসে বলল, বউদি, আপনার কি মাথাটা খারাপ হল?
কেন মদন, দরটা তত খারাপ নয়। চৌদ্দ লাখ তো অনেক টাকা!
এ বাড়ির চৌহদ্দির মাপ চার বিঘার ওপর, পাঁচ বিঘার কাছাকাছি। এখন শহরের এ জায়গায় লাখ টাকা করে কাঠা যাচ্ছে। শুধু জমির দামই তো কোটি টাকার কাছাকাছি!
শুনে মার চোখ কপালে উঠল, বলো কি মদন? এক কোটি?
বাড়ির দামটা ধরলে আরও দশ লাখ উঠবে। বাড়ির দাম বেশিই হত। কিন্তু পুরনো বাড়ি শাওলরাম রাখবে না। ভেঙে মালপত্র বেচবে। তা বেচলেও কম হবে না। বার্মা সেগুনের কাঠ আর মার্বেলের দামই তো কত উঠবে।
মা একটু হতাশ হয়ে বলল, অত কি দেবে? তবু শাওলরাম একটা দর দিয়েছে। আর তো কেউ দরও দিচ্ছে না।