বাহাদুর দুধের গেলাস নিয়ে এল।
টক করে খেয়ে নাও তো খুকুমণি।
কাঁচের গেলাসে সাদা দুধ, ওপরে আর নীচে দুটো চিনেমাটির প্লেট–দৃশ্যটা দেখলেই বন্দনায় জিব থেকে পেট অবধি বিস্বাদে ভরে যায়। দুধের চেয়ে খারাপ জিনিস পৃথিবীতে আর কী আছে? তবু রোজ খেতে হয়।
বাহাদুর তার মুখের দিকে চেয়ে একটু হাসে, নাক টিপে খেয়ে নাও। হারা দিব।
আগে দাও। বলে হাতখানা পাতে বন্দনা।
মা ওপর থেকে দেখছে কিন্তু। বলে বাহাদুর বা হাতে গেলাসটা ধরে ডান হাতে গায়ের খাটো হাতাহীন মোটা কাপড়ের সবুজ জামার ঝুল-পকেট থেকে কয়েকটা ভাজা কচি হাক বের করে তার হাতে দিল।
খেজুরের বিচির মতো সরু আর ছোট এই হকি বালিতে ভেজে কৌটোয় ভরে, দেশ থেকে নিয়ে আসে বাহাদুর। খেতে যে খুব ভাল লাগে বন্দনার তা নয়। কিন্তু বিস্বাদ কিছু খাওয়ার পর হার চিবোলে মুখ পরিষ্কার হয়ে যায়। মুচমুচে কষ কষ জিনিসটার ওই একটা উপকার আছে।
কোনও কিছুই সে তাড়াতাড়ি খেতে পারে না। আস্তে খায়, অনিচ্ছর সঙ্গে খায়। বাহাদুর সামনে উবু হয়ে বসে বলল, আজও জোর মারপিট লাগবে।
কার সঙ্গে?
বাবুর সঙ্গে ল্যাংড়ার। দোকান পসার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সকালে বাজারে গিয়ে শুনে এলাম।
আজ মারপিট হবে? কেন মারপিট হবে আজ? এমন সুন্দর একটা দিনে কোনও খারাপ ঘটনা কি ঘটতে পারে? রোদে হাওয়ায় এই যে উজ্জ্বল একটা ভাল দিন এল আজ, এ কি বৃথা হয়ে যাবে?
তাদের বাড়ির পিছনের দিকে দেয়ালের ওপাশে ভীষণ নোংরা একটা গরিব পাড়া আছে। শোনা যায় তারা একসময়ে এ বাড়ির প্রজা ছিল। ঘিঞ্জি অলিগলি আর খাপরা বা টালির ঘর, দু-চারটে পাকা বাড়ি, কাঁচা নর্দমা, মাইকের আওয়াজ আর ঝগড়া–এই সব নিয়ে ওই পাড়া। ওখানেই ল্যাংড়া নামে খোঁড়া একটা ছেলে থাকে। ভীষণ গুণ্ডা। আর বাবু হল সুবিমল স্যারের দলের ছেলে। সেও গুণ্ডা, তবে লেখাপড়া জানে। সে দক্ষিণের পাড়ায় থাকে। তার বাবা পঞ্চানন সেন উঁদে উকিল। বন্দনার বোকা দাদা প্রদীপ সুবিমল স্যার আর বাবুর পাল্লায় পড়েই পলিটিক্স করতে গিয়েছিল।
ভাজা হত্তুকি খাওয়ার পর জল খেলে জিবটা মিষ্টি মিষ্টি লাগে। কিন্তু বাহাদুরকে এখন জলের কথা বলার মানেই হয় না। বাহাদুর একটু তফাতে বাসের ওপর আঁট করে বসেছে।
ল্যাংড়া শালা গত সপ্তাহে দুটো পাম্প মেশিন চুরি করে এনেছে। ভোলা তুলছে। কোমরে আজকাল রিভলভার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
করুণ গলায় বন্দনা বলল, আজ ওসব কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না বাহাদুর। আমার মন খারাপ হয়ে যায়।
মাকে বলেছি, পিছনের দেওয়ালটা সারিয়ে নিতে। ল্যাংড়া খচ্চর একদিন ঢুকে ওইখানে জামগাছের তলায় দলবল নিয়ে মদ খাচ্ছিল। তোমার তখন জ্বর।
ও মাগো! কী সাহস!
ও শালার খুব বুকের পাটা।
মদ খাচ্ছিল? তোমরা কিছু বললে না?
কে কী বলবে? আমি গিয়ে বললাম, এখানে ঢুকেছিস কেন? বলল, তাতে তোর বাবার কী রে শালা? ফোট। আমি বললাম, হীরেনবাবুকে বলে দিলে তুলে নিয়ে যাবে। তাতে তেড়ে এল। তবে আর বেশিক্ষণ বসেনি।
হীরেনকাকুকে বলেছ নাকি?
আরে না। পুলিশওলাদের তো জানো। এরও খায়, ওরও খায়। হীরেনবাবু যদি তুলে নিয়ে যায় ল্যাংড়া একদিন বেরিয়ে আসবেই। তার আগে ওর দলবল হামলা চালাবে। আমাদের কে আছে বলো! ঝুটঝামেলা না করে দেয়ালটা গেঁথে দিলেই হয়। কত টাকারই বা মামলা?
দুধটার বিস্বাদ আর টের পাচ্ছিল না বন্দনা। তার সুন্দর দিনটা শেষ অবধি হাই হয়ে যাবে? তাদের এই স্বপ্নের বাড়ির মধ্যে কি ঢুকে পড়বে ওই বিচ্ছিরি বাইরেটা? এ বাড়ির মধ্যে তাদের একটা শান্ত, স্নিগ্ধ জগৎ। হয়তো অনেক চোরা-অন্ধকার আছে, তবু বাইরে থেকে এসে বাড়িতে ঢুকলেই একশো-দেড়শো বছরের পুরনো গন্ধ, পুরনো বাতাস, পুরনো আবহের রূপকথা যেন বুকে তুলে নেয়।
বাহাদুর একটু উদাস হয়ে সামনের দিকে চেয়েছিল। পঞ্চাশের ওপরে বয়স। বাড়ি উত্তরপ্রদেশের এক পাহাড়ি গ্রামে। বন্দনার জন্মের আগে থেকেই সে এ বাড়িতে আছে। মাঝে মাঝে দেশে যায়। তার খুব ইচ্ছেগোৰু আর মোষ কিনে দুধের ব্যবসা করে। কিন্তু তত টাকা আজও জমাতে পারেনি। তার দেশে বড় টানাটানি।
দুধটা শেষ করে গেলাসটা ঘাসের ওপর নামিয়ে রাখল বন্দনা।
তোমার দেশের গল্প করো না বাহাদুর।
এখন নয়। কাজ আছে। রাতে হবে।
গল্প কিছুই নয়। একটা পাহাড়ি গ্রাম, পাশে একটা ঝরনা বয়ে গেছে। সেখানে ছাগল চরে বেড়ায়, মকাই ধান গম হয়। গরিব লোকেরা কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকে। এই হল গল্প। তবু বন্দনা যেন গ্রামটা স্পষ্ট দেখতে পায়। পাথর গেঁথে ভোলা ঘর, ওপরে টিন বা টালির ছাউনি। নিরিবিলি, নিশ্চপ, তার মধ্যেই হয়তো একটা মোরগ ডেকে ওঠে। পাখিরা কলরব করে উড়ে যায়। ঝরনায় জল খেতে আসে ভীরু পায়ে হরিণেরা। গম পেষাইয়ের শব্দ ওঠে জাঁতায়। ফুল ফোটে। হাওয়া বয়। সন্ধের পর শীতের রাতে আগুন ঘিরে বসে গল্প করে গাঁয়ের লোকেরা। সেই গাঁয়ে কোনও বাইরের লোক যায় না। শুধু তারা থাকে তাদের নিয়েই। এই গাঁয়ের তেমন কোনও লোমহর্ষক গল্পও নেই। বাহাদুর শুধু মন্থর গলায় দীর্ঘ বিবরণ দিয়ে যায়। বন্দনার কী যে ভাল লাগে!
বন্দনার খুব ইচ্ছে করে একটা পাহাড়ি গাঁয়ে গিয়ে থাকে। বন্দনা তেমন কোথাও যায়নি কখনও। পাহাড়ে খুব কম। একবার দার্জিলিং গিয়েছিল। তখন থেকে পাহাড়ের কথা তার খুব মনে হয়।