দুটো একটা এরকম কেস কাটিয়ে উঠেছে অতীশ। আজ সারা সকাল আর এক জোড়া মুগ্ধ ও বিহ্বল চোখ তার সঙ্গে সঙ্গে ফিরেছে। এ চোখজোড়া দীপ্তির। অতীশের চেয়ে অন্তত পাঁচ সাত বছরের বড় এবং বিধবা এবং সন্তানের মা। আজকাল অবশ্য ওসব কেউ মানছে না। সব দিকেই শুধু বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও মাগান। কিন্তু বাঁধ ভাঙার দুটো বাধা আছে। মার্কসবাদের পাঠশালায় নৈতিকতার একটা শিক্ষা ছিল। ফস্টিনস্টি জিনিসটা মার্কসবাদে গৃহীত নয়। অন্য দিকে তার পারিবারিক ধারাটাও ওরকমই কিছু একটা তার মধ্যে সঞ্চারিত করে থাকবে।
রিক্সা চালানোটা যে একটা ভীষণ বীরত্বের ব্যাপার এবং অতীশ রিক্সা চালিয়ে যে এই অন্তঃসারশূন্য সভ্যতাকে চাবুক মারছে, সভ্যতার মুখোশ টেনে খুলে ফেলছে এসব শক্ত কথা তার কস্মিনকালেও মনে আসেনি। তার বাড়ির কেউ পছন্দ না করলেও অতীশ রিক্সা চালিয়েছে বসে না থেকে কিছু একটা করার তাগিদে। সেটা যে এরকম একটা মহান ব্যাপার তা দীপ্তিই আজ তাকে শিখিয়েছে। শহর দেখতে দেখতে তাকে একবার দীপ্তির সঙ্গে শহরের সবচেয়ে ভাল রেস্তোরাঁয় বসে গল্পও করতে হয়েছে। তখন দুখানা চোখের সব সম্মোহন উজাড় করে দিয়েছে দীপ্তি। কলকাতার মেয়ে তো, ওদের সব ব্যাপারে তাড়াহুড়া। মোটে সময় দিতে চায় না কিছুতে।
বলল, আপনি আমার সঙ্গে কলকাতায় চলুন। ওখানে অনেক স্কোপ। আমার ফ্ল্যাটটাও মস্ত বড়, দেড় হাজার স্কোয়ার ফুট। স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন।
আর একটা শিথিল মুহূর্ত এল দুপুরবেলায় নির্জন নদীর ধারে কাছারির ঘাটে দাঁড়িয়ে। বটের ঝিরঝিরে ছয়া, নীচে ঘাট, ঘাটে ডিঙি নৌকো বাঁধা, জলের কুচি কুচি ঢেউয়ে রোদের হিলিবিলি। খপ করে তার হাতটা নিজের নরম কবোষ্ণ হাতে ধরে ফেলে দীপ্তি বলল, আপনাকে আমার এত ভাল লাগছে কেন বলুন তো। এই শোনন, এখন থেকে তোমাকে আমি তুমি বলব। তুমিও বলবে তো!
মফস্বলি মাথায় এসব সহজে ঢুকতে চায় না। এ যেন সিনেমা বা উপন্যাস। সত্যি নয়। ভদ্রতাবশে হাতটা ছাড়াতেও পারেনি অতীশ। খেয়ার মাঝি বুড়ো মৈনুদ্দিন তার খোড়ো ঘরের দরজায় বসে দৃশ্যটা দেখছিল।
দীপ্তি ধরা গলায় বলল, আমার কিছুই অভাব নেই, জানো? আমার হাজব্যান্ড প্রচুর রোজগার। করত। ব্যবসা ছিল, শেয়ার কেনার নেশাও ছিল। ব্যাঙ্কে আমার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পচছে। বছরে কত টাকা ডিভিডেন্ড পাই ভাবতেও পারবে না। অভাব কীসের জানো? আমার ভালবাসার একটা লোক নেই। এমন একজন যার জন্য প্রাণপাত করে কিছু করতে ইচ্ছে করে। যাকে ঘিরে লতিয়ে ওঠা যায়। মেয়েদের তো লতার সঙ্গেই তুলনা করা হয়, না?
মৈনুদ্দিন ঠিক এ সময়টায় গলা খাঁকারি দিয়েছিল। গলার দোষ হতে পারে, আওয়াজ দেওয়াও হতে পারে।
চলো, নৌকোয় একটু বেড়িয়ে আসি। যাবে?
তা গেল অতীশ। মরা নদীতে চর পড়ে গেছে অনেকটা। ওপাশের সরু ধারাটায় কিছু গভীরতা আছে, এপাশে হাঁটুজল। মৈনুদ্দিন চরটা পাক মেরে ওপাশের শ্মশানঘাট অবধি নিয়ে গেল। দীপ্তি মুগ্ধ, স্বপ্নাতুর। ডিঙির হেলদোলে বারবার মুখোমুখি বসা অতীশের হাত চেপে ধরছিল। ওর গা থেকে নানা ধরনের সুগন্ধি আসছিল তখন। অতীশ হলফ করে বলতে পারবে না যে, তার খারাপ লেগেছিল। কিন্তু ভিতরে হচ্ছিল অন্যরকম। সেখানে যেন তুফানে পড়া নৌকো বাঁচাতে সামাল সামাল বলে গলদঘর্ম হচ্ছে দুই পাকা মাঝি। মার্কস আর রাখাল ভট্টাচার্য।
কাছারির ঘাটে যখন এসে নৌকো ভিড়ল তখন দীপ্তি একটু একটু মাতাল। অতীশের হাত জড়িয়ে ধরে টলতে টলতে উঠে এল ভাঙা পাড় বেয়ে। বটগাঙ্কে ঝিরঝিরে ছায়ায় তার দুখানা চোখ তুলে শুভদৃষ্টির কনের মতো অতীশের দিকে স্বপ্নাতুর চেখে বলল, কী ভাল লাগল, না?
অতীশ ভেবেছিল, এই অস্থায়ী সম্মোহনটা কেটে যাবে। সে রিক্সাটা টেনে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, এবার যেতে হবে।
দীপ্তি মাথা নেড়ে মিষ্টি হেসে বলল, না। এখনই না। একটু বোসস তো আমার পাশে।
অতীশ একটু গাঁইগুই করতে যাচ্ছিল, কিন্তু হাত ধরে টানলে সে কী করতে পারে? রিক্সা বড় ঘেঁস জায়গা। দুজনকে খুব চেপে ধরল একসঙ্গে।
দীপ্তি একটু হাসির ঝিলিক তুলে তার দিকে তাকাল। তাকাতেও পারে বটে মহিলা। তাকিয়ে তাকিয়েই খুনখারাবি করে দিতে পারে। অতীশ তো আর পাথর নয়। মার্কস এবং রাখাল ভট্টাচার্য দুজনেই সাধ্যমতো লড়েছেন। কিন্তু তাঁরা বুড়ো মানুষ, কটাক্ষের ধারে কচুকাটা হওয়ার জোগাড়। দুই বুড়ো হেদিয়ে পড়েছেন তখন। আর সেইসময়ে ডাইনির শ্বাসের মতো সর্পিল সব অদ্ভুত বাতাস আসছিল নদীর জল ছুঁয়ে। আর তখন রোদের আলোয় সঞ্চারিত হচ্ছিল ভুতুড়ে রং। আর দীপ্তির গা থেকে মদির এক গন্ধ আসছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে, দ্বিপ্রহরে, লোকলজ্জা ভুলে বসে ছিল অতীশ। ভগবানের দিব্যি, তার খারাপ লাগছিল না। ওইভাবে বসে থাকাটার কোনও কারণ নেই, প্রয়োজন নেই, তবু কেন যে ভাল লাগছিল তা কে বলবে?
কাছাকাছি মুখ, দীপ্তি তার গালে শ্বাস ফেলে বলল, তোমার এত গুণ, কেন যে মফস্বল শহরে পড়ে আছ! এখানে তোমার কিছু হবে না। তোমার কলকাতায় যাওয়া উচিত।
কলকাতায় গেলে তার কী হবে তা অতীশ বুঝতে পারল না। তবে সে প্রতিবাদও করল না। মার্কসবাদের শিক্ষা তাকে টাকাওলা লোকদের ঘৃণা করতেই প্ররোচিত করেছে। কিন্তু কার্যত তা পেরে ওঠেনি অতীশ। বরং টাকাওলা মানুষজনকে সে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই একটু সমীহ করতে থাকে। দীপ্তির প্রতিও তার সমীহের ভাবটা এসে পড়ছিল। তার সঙ্গে ছিল একটা শরীরী উত্তেজনা। আরও ছিল, একটু মোহ- স ভাব। আরও কিছু থাকতে পারে। অত জটিল, সূক্ষ্ম ব্যাপার সে বুঝতে পারে না।