পারব না? আমি পারব না? ভগবান! অতীশের সঙ্গে গৌরাঙ্গের দূরত্ব বাড়েনি। একই আছে। এখনও। কিন্তু গৌরাঙ্গর কুঁচকিতে ব্যথা নেই। দূরত্বটা থেকেই যাবে।
একটা বাঁক আসছে। অতীশ বুক ভরে একটা দম নেওয়ার চেষ্টা করল। বুক হাফরের মতো শব্দ করে উঠল হঠাৎ। দুটো পায়ে নবতর শক্তি সঞ্চার করার জন্য অতীশ তার পা দুখানার উদ্দেশে বলতে লাগল, কাম অন! কাম অন বয়েজ! কাম অন…
একটা ছায়ার মতো গৌরাঙ্গকে নিজের পাশাপাশি দেখতে পেল অতীশ। তারপর ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল। সামনে শুধু নবেন্দু।
আর কতখানি বাকি? চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছে না অতীশ। চারপাশটা কেমন যেন ছায়া-ছায়া, যেন ওয়াশের ছবির মতো আবছা! চোখে নেমে আসছে কপালের অবিরল ঘাম। একটা তীব্র, অসহনীয় ব্যথার গর্জন শুনতে পাচ্ছে সে। এ ছাড়া শরীর-বোধ লুপ্ত হয়ে গেছে তার। শুধু টেনে নিচ্ছে নিজেকে, হিঁচড়ে ছেড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রোগ ও জরাগ্রস্ত মানুষ যেভাবে প্রায় শবদেহের মতো নিজের অস্তিত্বকে আমৃত্যু টানে। কিন্তু শরীর কীসের জন্য, যদি তার কাছ থেকে আদায় না করা যায় অস্তিত্বের সুফল?
বহু দূরে সে ট্র্যাকের ওপর একটা টানা আবছা লাল ফিতে আর কয়েকজন মানুষকে দেখতে পেল। ওই কি শেষ সীমানা? নবেন্দু এখনও প্রায় চার পাঁচ ফুট আগে। এতটা গ্যাপ! অসম্ভব! অসম্ভব!
কে যেন অতীশের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, পারব! পারতেই হবে। কাম অন বয়েজ। কাম অন…
মাধ্যাকর্ষণ বড় প্রবল। তাকে টেনে নিতে চাইছে ভূমিশয্যা। তার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে জলে ডুব দিয়ে বসে থাকতে। ইচ্ছে করছে লেবুপাতা দিয়ে মাখা পান্তাভাত খেতে। তার ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সব প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে।
সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য? জাগল অতীশ। দেখল। নবেন্দু কি আরও একটু এগিয়ে গেছে? নবেন্দুকে না সে আগেরবার অনেক পিছনে ফেলে জিতেছিল?
কাম অন বয়েজ। কাম অন।
দুটো পা লোহার মতো ভারী। শব্দ হচ্ছে ধপ ধপ। যেন হাতির পা। গোদা পা। তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না তারা।
নবেন্দু একবার ঘাড় ঘোরাল। তাকে দেখে নিল।
ভূল! মারাত্মক ভুল। ঘাড় ঘোরাতে নেই কখনও। অন্তত শেষ ল্যাপে নয়। দুটো কদম যোগ করে নিল অতীশ। গ্যাপ কমে গেছে। আর একটু… আর একটু…
গ্যাপ কমছে। কমছে।
কাম অন বয়েজ…।
শরীরের একটা উথাল পাথাল তুলল অতীশ। দৌড়োচ্ছ না, যেন নিজেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে সামনে। ঢেউয়ের মতো।
নবেন্দু দ্বিতীয় ভুল করল, আবার ফিরে তাকিয়ে। তার চোখে বিস্ময়। হাঁটুতে হাঁটুতে লেগে একবার ভারসাম্য হারাতে হারাতে সোজা হল নবেন্দু।
অতীশ মনে মনে বলল, ধন্যবাদ। ধন্যবাদ। ধন্যবাদ।
একটা ঝটকায় তারা পাশাপাশি। কারা চিৎকার করছে মাঠের বাইরে থেকে? কাদের মিলিত কণ্ঠ জয়ধ্বনির মতো তার নাম ধরে ডাকছে, অতীশ! অতীশ!
শেষ কয়েক পা অতীশ দৌড়োল একশো মিটারের দৌড়ের মতো। প্রাণ বাজি রেখে।
লাল ফিতে বুক দিয়ে ছুঁয়ে সে একবার দুহাত ওপরে তুলবার চেষ্টা করল। তারপর সেই দুই হাতে একটা অবলম্বন খুঁজতে খুঁজতে চোখ ভরা অন্ধকার নিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাঠে। সে জিতেছে!
চোখে মুখে জলের ঝাপটা খেয়ে দু মিনিট বাদে তার জ্ঞান ফিরল। আরও দশ মিনিট বাদে ভিক্টরি স্ট্যান্ডে উঠল সে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে। চারদিক ফেটে পড়ছে উল্লাসে। সে জানে, সে অলিম্পিক জেতেনি, বিশ্বরেকর্ড করেনি। ভারতবর্ষের এক ছোট্ট অখ্যাত শহরে জেলাওয়ারি একটা প্রতিযোগিতায় জিতেছে মাত্র। তার নাম ছোট্ট করেও বেরোবে না খবরের কাগজে। তার এই কৃতিত্বের কথা দর্শকরা দু দিন বাদেই ভুলে যাবে। হয়তো এই জয়ের দাম দিতে চিরকালের মতো বসে যাবে তার ডান পা। তবু নিজের ভিতরে সে এক নবীকরণ টের পেল। বারবার নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে না পারলে তার এই ছোট বেঁচে থাকা যে বড় নিরর্থক হয়ে যায়!
.
হর্ষধ্বনি ও হাততালি, পিঠ চাপড়ানি আর হ্যান্ডশেক এ সবই অতি উত্তেজক জিনিস। তার চেয়েও মারাত্মক কিশোরী ও যুবতীদের চোখে ক্ষণেকের বিহ্বল ও সম্মোহিত চাহনি। যদিও এসবই অস্থায়ী, তবু সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারে না অতীশ। এই খেলার মাঠ থেকেই তার চোখের সামনে কতগুলো প্রেম হল, তাদের বেশ কয়েকটা বিয়ে অবধি গড়িয়ে গেল। মানুষ যখন হঠাৎ করে লাইমলাইটে চলে আসে তখন সাবধান না হলে মুশকিল। এ সবই অতীশ জানে। মাত্র এক বছর আগে এই মাঠেই এরকমই স্পোর্টসের দিনে শিখা তার প্রেমে পড়েছিল। ভি আই পিদের জন্য সাজানো চেয়ারে বসে হাঁ করে তার দৌড় দেখতে দেখতে বিহ্বল হয়ে গেল, বিবশ হয়ে পড়ল। তারপরই ওদের কাজের মেয়ে ময়নার মারফত চিঠির পর চিঠি আসতে লাগল অতীশের কাছে। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। এখানে সেখানে দেখা করতে বলত। অতুলবাবুর মেয়ে বলে কথা, তাকে অপমান করলে কোথাকার জল কোথায় গড়াবে তার ঠিক কী? তাই দু একটা চিঠির জবাব ময়নার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল অতীশ। তাতে খুব বিনয়ের সঙ্গে সে জানিয়েছিল যে, সে মোটেই শিখার উপযুক্ত নয়। সে অত্যন্ত গরিব ও নাচার. ইত্যাদি। দেখা-সাক্ষাতেও এসব কথাই সে বলত। কিন্তু শিখার তখন জর-বিকারের মতো অবস্থা। দুনিয়া এক দিকে, অতীশ অন্য দিকে। শিখা তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। অতীশ পালিয়েছিল ঠিকই, তবে শিখাকে নিয়ে নয়, শিখার হাত থেকে। হাওড়ার কাছে একটা গ্রামে তার মামার বাড়িতে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল। বাঁচোয়া এই যে, খেলার মাঠের এইসব সম্মোহন আর বিহ্বলতা বেশিক্ষণ থাকে না। বড় অস্থায়ী। চিতু নামে ডাক্তারি পাশ করা একটি ছেলে শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলল। বেঁচে গেল অতীশ। তবু তার সেই অ্যাকসিডেন্টটার কথা খুব মনে হয়। চালপট্টিতে শিখার গাড়ির ধাক্কায় সে চিতপটাং হয়ে গিয়েছিল। অল্পের জন্য বড় চোট হয়নি। সেদিনকার আর সব চোট তুচ্ছ মনে হয়, যখন মনে পড়ে, সেদিন শিখা তাকে চিনতে পারেনি।