সে শুনতে পাচ্ছিল, বহু দূরে একটা বিচ্ছিরি লাউড স্পিকারে অপরূপা দিদিমণি চিৎকার করে একটা ভাষণ দিচ্ছে। কী বলছে তা এত দূর থেকে শোনা গেল না। ল্যাংড়াকে বন্দনা পছন্দ করে ঠিকই, তবু অপরূপা দিদিমণি যে ওর জন্য এত বিপদ মাথায় নিয়েও একটা লড়াই করছে এটা খুব ভাল লাগে বন্দনার। সে নিজে তো কারও জন্য কখনও লড়াই করেনি। তার তো কোনও লড়াই নেই। ল্যাংড়া বাঁচাও আন্দোলন বলে অপরপাদিকে ঠাট্টা করে গেল বটে অবু, কিন্তু ঠাট্টা শুনে বন্দনার একটুও হাসি পায়নি। অপরূপাদিকে নিয়ে ঠাট্টা করার সে কে?
তার পোষা কয়েকটা কবুতর ছাদ থেকে নেমে এল ঝটপট করতে করতে। তারপর তার চেয়ার ঘিরে গুড়গুড় শব্দ করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মনটা যেন একটু ভাল হয়ে উঠতে যাচ্ছিল। ফের অনেক কথার হয়া এসে পড়ল মনের ওপর।
দীপ্তিদিকে তার কেন আর একটুও ভাল লাগছে না? এই মস্ত ফাঁকা বাড়িটায় তারা তিনটি মোটে প্রাণী। সে, বিলু আর মা। সারাদিন তারা নানা বিষণ্ণতায় ডুবে থাকে। তাই কেউ এলে ভীষণ আনন্দ হয় বন্দনার। তাকে আর ছাড়তেই চায় না। ঠিক যে রকম হয়েছিল রমা মাসির বেলায়। রমা মাসিকে চোখের আড়াল করত না সে। তারপর একদিন এমন হল যখন রমা মাসি ফিরে গেলে সে বাঁচে। শেষে রমা মাসি গেল বটে, কিন্তু নিয়ে গেল তার জীবনের সব আনন্দ, সব আলো, সব উভাস। কাল যখন দীপ্তিদি এল, তখন কী যে আনন্দ হয়েছিল বন্দনার। আজ মনে হচ্ছে, দীপ্তিদি চলে গেলেই ভাল। ওকে আর একটুও ভাল লাগছে না তার। বিধবা হয়েও মাছ-মাংস খায়, একাদশী অম্বুবাচী করে না, পুরুষদের সঙ্গে ঢলাঢলি করে বেড়ায়। অতীশ কি এত সব জানে? জানে কি যে, দীপ্তিদির জন্যই তার বর আত্মহত্যা করেছিল? নিশ্চয়ই জানে না, জানলে এত মেশামেশি করত কখনও? দীপ্তিদি আজ সকালে নিজের ঘরে খুব গুনগুন করে গান গাইছিল। খুশিতে মুখখানা খুব ডগোমগো। কীসের এত আনন্দ ওর? একজন বিধবার কি এত আনন্দ করা উচিত? বিশেষ করে যে বাড়িতে এত দুঃখ, এত শোকতাপ?
৪. লাস্ট ল্যাপ
০৪.
টুপি মাথায় একটা লোক চেঁচিয়ে বলছিল, লাস্ট ল্যাপ! লাস্ট ল্যাপ! কথাটা অতীশের কানে ঢুকল, কিন্তু বোধে পৌঁছোল না। শেষ ল্যাপ বলে কিছু কি আছে? সামনে অফুরান মাঠ। চুনের দাগ যেন দূর পাল্লার রেললাইনের মতো অনন্তে প্রসারিত। ইনজেকশনের ক্রিয়া অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছে। তার কুঁচকিতে এখন কুমিরের কামড়। চিবিয়ে খাচ্ছে হাড়গোড়, মাংস, মজ্জা, আগুন জ্বলছে ব্যথার। আগের ল্যাপে সে ডিঙিয়েছে সুকুমার আর আজিজুলকে। তিন চার ফুট আগে দৌড়োচ্ছ গৌরাঙ্গ, আরও আগে নবেন্দু। অসম্ভব! অসম্ভব! এই দৌড়টা সে পারবে না।
কিন্তু সেই মানুষ পারে, যে কিছুতেই হার মানে না। আগের তিনটে রেস সে জিতেছে। তখন ইনজেকশনের ক্রিয়াটা ছিল, পান্নাও কম। একশো, দুশো আর চারশো মিটার। চারশো মিটারের পর অনেকগুলো অন্য আইটেম ছিল। যত সময় গেল তত কমে গেল ওষুধের ক্রিয়া। ডাক্তার অমল দত্ত অবশ্য তাকে বলেছিলেন, এই পা নিয়ে দৌড়োবি? পাগল নাকি? তোর পায়ের অবস্থা ভাল নয়। স্ট্রেন পড়লে পারমানেন্টলি বসে যাবি।
কথাটা কানে তোলেনি সে। কাকুতি মিনতি করেছিল। ডাক্তার দত্ত একটু ভেবে বলেছিলেন, স্পোর্টসের ঠিক আগে আসিস। দিয়ে দেব।
পার্মানেন্টলি বসে যাওয়ার কথা শুনেও ভয় পায়নি অতীশ। ভয় পাওয়ার নেইও কিছু। এই দুটো পা তাকে অনেক দিয়েছে। কিন্তু দুটো পাকে কী দিতে পেরেছে সে? পেটে পুষ্টিকর খাবার যায় না, যথেষ্ট বিশ্রাম নেই, যথোচিত ম্যাসাজ হয় না, এমনকী একজোড়া ভদ্রস্থ রানিং স্পাইক অবধি নেই। তবু অযত্নের দুখানা পা তার হাত ভরে দিয়েছে প্রাইজে। আর পা দুটোকে বেশি খাটাবে না অতীশ। বয়সও হচ্ছে। হাঁটাচলা বজায় থাকলে, আলু বেগুনের বোঝা বইতে পারলেই যথেষ্ট।
ধপ ধপ ধপ ধপ করে মাঠের ওপর কয়েকজোড়া ক্লান্ত ভারী পা পড়ছে, উঠছে, পড়ছে উঠছে। হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো। পাঁচ হাজার মিটারের শেষ ল্যাপ এক মারাত্মক ব্যাপার। দীর্ঘ দৌড়ের শেষে এসে জেতার ইচ্ছে উবে যায়, দিকশূন্য ও উদভ্রান্ত লাগে, বুক দমের জন্য আকুলি ব্যাকুলি করে, হাত পা মাথা সব যেন চলে যায় ভূতের হেফাজতে। নিজেকে নিজে বলে মনে হয় না। অতীশের মাথা থেকে পায়ের তলা অবধি ঘামছে। গায়ের শার্ট ভিজে লেপটে আছে গায়ের সঙ্গে। চোখ ধোঁয়া ধোঁয়া। বুদ্ধি কাজ করছে না। ধৈর্য থাকছে না, মনের জোর বলে কিছু নেই। কত দুর অবধি চলে গেছে চুনের দাগে চিহ্নিত ট্র্যাক! এই দৌড়টা মারতে পারলে সে হবে ওভার-অল চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়নকে আজ দেওয়া হবে একটা সাদা কালো টিভি। সেটা বেচলে হাজার বারোশো টাকা চলে আসবে হাতে। সুমিত ব্রাদার্সের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।
তার অগ্রবর্তী দুজন দৌড়বাজের অবস্থাও তারই মতো। ঘাড় লটপট করছে। পা টানছে না, স্পিড বলে কিছু নেই। শুধু একটু ইচ্ছের ইনজিন টেনে নিচ্ছে তাদের।
মিউনিসিপ্যালিটির মাঠ ভাল নয়। একটা গর্তে বাঁ পাটা পড়তেই টাল খেল শরীরটা। পড়লে আর উঠতে পারবে না অতীশ। কী বলছিল লোকটা? লাস্ট ল্যাপ! সর্বনাশ! লাস্ট ল্যাপ! অতীশ কি পারবে না? ধোঁয়াটে মাথায় একটা লোকের চেহারা মনশ্চক্ষে দেখতে পেল অতীশ। না, লোকটাকে সে কখনও দেখেনি। তার ছবিও না। তবু দেখল। কোন অলিম্পিকে যেন ম্যারাথন দৌড়োচ্ছিল লোকটা। লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে মচকে গেছে পা। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে তবু দৌড়ে যাচ্ছিল সে। প্রাইজের আশা ছিল না, শুধু দৌড়টা শেষ করতে চেয়েছিল। দৌড় শেষ করাই ছিল। আসল কথা। শেষ অবধি সকলের পরে সে যখন স্টেডিয়ামে ঢুকল তখন অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। স্টেডিয়ামের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে লোকটা শুধু প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে শেষ করছে দৌড়। সমস্ত স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়াল তার সম্মানে। করতালিতে ফেটে পড়ল চারদিক। বিজয়ী সে নয়, তবু এক অপরাজেয় মানব। কোনও মেডেলই পায়নি সে, তবু সে লক্ষ মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিল মানুষের আবহমানকালের সংগ্রামের ইচ্ছাকে।