এঃ, তুই যে একদম শুঁটকি মেরে গেছিস! কী হল তোর?
বন্দনার বুকটা ধকধক করছিল, বলল, এমন চমকে দিয়েছিস!
অবু, অর্থাৎ অবিনশ্বর অতুলবাবুর ছেলে, শিখার ভাই এবং তারই সমবয়সী। শিখাদের বাড়িতে তারা একসঙ্গে কত ক্যারম লেখেছে! অবু বেশ লম্বা চওড়া, নবীন দাসের ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করে।
তোর কি অসুখ ফসুখ কিছু করেছিল নাকি রে বন্দনা?
টাইফয়েড।
তাই অত রোগা হয়ে গেছিস। তোকে চেনাই যাচ্ছে না। রোজ ছোলা ভেজানো খা, আর এক গ্লাস করে মোল, আর দু চামচ ব্র্যান্ডি মেশানো দুধ, দেখবি তাক এসে যাবে।
তোর মতো হোঁতকা না হলেও আমার চলবে।
আমি হোঁতকা নাকি? আমি হলাম মাসকুলার। বাইসেপ দেখবি?
মা গো! ওসব কিলবিলে মা দেখলে আমার বিচ্ছিরি লাগে। বোস না, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
আরে, বসবার জন্য কি এসেছি নাকি? তোদের বাড়ি পাহারা দিচ্ছি।
পাহারা দিচ্ছিস! তার মানে?
তোদের বাড়িতে নাকি ল্যাংড়া একটা ঠেক করেছে! সেই জন্যই বাবুদা পাঠাল পাহারা দিতে। ল্যাংড়া অবশ্য পালিয়ে গেছে। তবু যদি আসে।
বন্দনা হেসে ফেলল, তুই একা পাহারা দিচ্ছিস! ইস, কী আমার বীর রে!
অবু একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমি একা নই। বিশ্বজিৎ আর অমল নামে দুটো ছেলেও আছে। ওদের রিভলভার আছে। আমি হচ্ছি মেসেনজার। কিছু হলে দৌড়ে গিয়ে খবর দিতে হবে বাবুদাকে।
বন্দনা ভয় পেয়ে বলল, রিভলভার! রিভলভার কেন বল তো!
অবু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ভয় পেলি নাকি? আরে দূর, আজকাল রিভলভার টিভলভার হাতে হাতে ঘোরে। কোনও ব্যাপারই নয়। আজকাল রিভলভার হল খেলনা। আসল জিনিস হল স্টেনগান, এ কে ফর্টি সেভেন, এইসব।
তুই খুব পেকেছিস কিন্তু অবু।
অবু হি হি করে হাসল। সবে গোঁফের রেখা উঠেছে, ফসা, গোল মুখের অবু এখন কত ছেলেমানুষ। বলল, আজ তা হলে তুই কলসি রেসে নামছিস না?
বন্দনা লজ্জায় রাঙা হল। বরাবর সে প্রগতি সংঘের স্পোর্টসে কলসি মাথায় দৌড়ে নাম দেয়। আজ অবধি একবারও পারেনি। তার মাথা থেকে কলসি পড়বে কি পড়বেই। সে লজ্জায় হাসতে লাগল, যাঃ।
তোর ঠ্যাং দুটো খুব সরু সরু তো, তাই তোর ব্যালান্স নেই। ললিতাদি যোগ ব্যায়ামের ক্লাস খুলেছে। ভর্তি হবি? দুদিনে চেহারা ফিরিয়ে দেবে।
যাঃ। ব্যায়াম জিনিসটা এত বাজে আর একঘেয়ে।
আর শুঁটকি হয়ে থাকা বুঝি ভাল?
শুঁটকি আছি বেশ আছি, তোর তাতে কী? আজকাল রোগা হওয়াই ফ্যাশন, জানিস?
তা বলে তোর মতো রোগা নয়। তুই তো বারো মাস ভুগিস। আজ জ্বর, কাল সর্দি, স্কিপিং করলে পারিস।
ওসব আমার ভাল লাগে না। ক্যারম খেলবি অবু?
অবু তাঁর কবজির ঘড়িটার দিকে একবার চেয়ে বলল, ক্যারম খেলব কী রে? আমি এখন অন ডিউটি রয়েছি না। আমি এখন ব্ল্যাক ক্যাট। কম্যান্ডো। তোদের সিকিউরিটি গার্ড।
ল্যাংড়াকে দেখলেই তো পালাবি।
অবু হি হি করে হাসল। তারপর বলল, ল্যাংড়া তোদের বাড়িতে ঢুকে কী করে বল তো! বোমা ফোমা বাঁধে নাকি?
ঠোঁট উল্টে বন্দনা বলে, কে জানে কী করে! আমাদের বাড়িটা তো এখন খোলা হাট।
জানিস তো আজ অপরূপা দিদিমণি বস্তিতে মিটিং করবে! সবাইকে নাকি ডেকে ডেকে বলবে ল্যাংড়াকে সাপোর্ট করার জন্য। ল্যাংড়া নাকি পাড়ার লোকের উপকার করে বেড়ায়, পাড়ার জুয়ার ঠেক নাকি সেই ভেঙেছে, ল্যাংড়ার জন্যই মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশানে বাবুদাদের ক্যান্ডিডেট বিধুবাবু জিততে পারেনি। অপরূপাদি সবাইকে এসব কথা বলে বেড়াচ্ছে। আমরা নাম দিয়েছি ল্যাংড়া বাঁচাও আন্দোলন।
বন্দনা করুণ মুখ করে বলল, কিন্তু অপরূপাদি দারুণ পড়াত। এত সুন্দর সুন্দর গল্প বলত ক্লাসে।
আরে সে তো আমিও জানি। দিদিও তো পড়ত ওর কাছে। কিন্তু ল্যাংড়ার সঙ্গে অ্যাফেয়ারের পর অপরূপাদি একদম ভোগে চলে গেছে। ল্যাংড়াকে পাটিতে ঢুকতে দিচ্ছে না কে জানিস তো। অপরূপাদি। আরে, আজকাল পাটির শেল্টার না পেলে কেউ কি কিছু করতে পারে? ল্যাংড়া যদি মরে তবে অপরূপাদিই কিন্তু রেসপনসিবল।
বন্দনা চোখ পাকিয়ে বলল, তুই এত পেকেছিস কবে থেকে রে? খুব পার্টি করে বেড়ানো হচ্ছে?
আরে না। পার্টি ফার্টি তারাই করে যাদের হাতে মেলা সময় আছে। আমার বলে হেভি পড়ার চাপ, তার ওপর বডি বিল্ডিং, সময় কোথায়? তবে বাবুদা বা সুবিমল স্যার বললে মাঝে মাঝে ফ্যাক খেটে দিই। বাবাকে তো জানিস, পার্টি করলে পুঁতে ফেলবে।
তা হলে করিস কেন?
সোশ্যাল ওয়ার্ক হিসেবে কিছু কিছু করি। পলিটিকস নয় বাবা। তোদের বাড়ি পাহারা দেওয়াটাও ভো একটা সোশ্যাল ওয়ার্ক, নাকি? আফটার অল তোরা একসময়ে আমাদের জমিদার ছিলি।.একটা দায়িত্ব আছে।
নাঃ, তুই সত্যিই খুব পেকেছিস।
অবু হি হি করে হাসল।
তোর ভয় করে না অবু?
কীসের ভয়?
জানিস তো, আমার দাদার কী হয়েছিল!
জানব না কেন? স্যাড ব্যাপার।
পিছন দিকে একটু দূরে একটা কর্কশ লাউড স্পিকারে মাইক টেস্টিং শুরু হতেই কথা থামিয়ে উৎকর্ণ হল। তারপর বলল, ওই বোধহয় অপরূপাদির মিটিং শুরু হল। যাই, শুনে আসি। ইন্টাররেস্টিং ব্যাপার হবে।
অবু হালকা পায়ে বাগানটা পার হয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে গলে বাইরে বেরিয়ে গেল। গাছের ঘয়ায় একা কুম হয়ে বসে রইল বন্দনা। হাতে বাবার চিঠি। মাথার মধ্যে কত চিন্তা ভেসে ভেসে ছায়া ফেলে যাচ্ছে। আজ তার মনে হল, পৃথিবীতে তাদের মতো দুঃখী মানুষ আর কেউ নেই।