বন্দনা কী করে মাকে বোঝাবে যে, বাবা মোটেই বাড়ির দখল চায়নি। বাবা চেয়েছে এ বাড়ির এক কোণে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘরে ভিখিরির মতো একটু আশ্রয়। তার বাবা একটা গর্হিত অন্যায় করে ফেলেছে ঠিকই, তবু বাবা একজন চমৎকার মানুষ। একজন কবির মতো মানুষ। একজন নরম ও উদাসী মানুষ।
মা সে কথা বুঝল না। বলল, তাকে তোরা আর কতটুকু চিনিস? আমি চিনি হাড়ে হাড়ে। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে এ বাড়িতে থাকতেও আমার ঘেন্না হচ্ছে। এখন সে এসে নতুন বউ, নতুন ছেলে নিয়ে সুখের সংসার পাতুক। আমরা বিদেয় হয়ে যাব।
কিন্তু বন্দনার এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। এ বাড়ির মধ্যে কত পুরনো বাতাস, কত অদ্ভুত আলোছায়ার খেলা, কত স্বপ্নের মতো ব্যাপার আছে। এ বাড়ি ছেড়ে গিয়ে কি সে বাঁচবে?
সকাল নটায় একটা রিক্সা এসে সামনের উঠোনে থেমে পক পক করে হর্ন দিচ্ছিল। শরৎ রচনাবলী রেখে বন্দনা গিয়ে বুকে দেখে অবাক। রিক্সায় অতীশ সিটে বসে আছে। উধ্বমুখে চেয়ে আছে বারান্দার দিকে। দেখে বন্দনার ভিটা জ্বলে গেল।
কী চাও!
অতীশ গম্ভীর মুখে বলল, তোমার কলকাতার দিদি আসতে বলেছিল। শহর দেখবে।
তোমার রিক্সায়?
হ্যাঁ।
রাগে এত গরম হয়ে গেল তার মাথা যে সে কিছুই বলতে পারল না। খানিকক্ষণ জ্বালাভরা চোখে অতীশের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, তুমি না একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছিলে?
হ্যাঁ।
তবু চালাচ্ছ?
গাড়ি চালালে একটা দুটো অ্যাকসিডেন্ট হয়ই।
এত অপমান লাগছিল বদনার যে, বলার নয়। সে উঠে দীপ্তির ঘরে গেল।
এই দীপ্তিদি।
দীপ্তি একটা হলুদ জমি, কালো টেম্পল পাড়ের শাড়ি পরছিল যত্ন করে। স্নান করে এসেছে। ভেজা চুল এলানো রয়েছে পিঠের ওপর। হাসিমুখে বলল, কী রে?
তুমি অতীশদাকে রিক্সার কথা বলেছ?
হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে গেল দীপ্তির। চোখ উজ্জ্বল হল। বলল, কী সাঙ্ঘাতিক ছেলে বল তো!
সাঙ্ঘাতিকটা আবার কীসের দেখলে?
বিকম পাশ, ওরকম ভাল চেহারা, কী ভাল সংস্কৃত উচ্চারণ, ভাল অ্যাথলিট, সেই ছেলে রিক্সা চালায়, এটা একটা দারুণ ব্যাপার নয়?
আমার তো রাগ হয়।
আমার শ্রদ্ধা হয়। ও ছেলে যখন রিক্সা চালায় তখন সেইসঙ্গে এই সমাজকে যেন অপমান করে। যে দেশ ওরকম একটা ছেলের দাম দিতে পারে না, সে দেশকে এভাবেই অপমান করা উচিত।
বন্দনা এসব তত্ত্ব বোঝে না। তবে অতীশ রিক্সা চালালে তার ভীষণ লজ্জা করে। সে কুঁকড়ে যায়।
প্লিজ দীপ্তিদি, তুমি ওর রিক্সায় উঠো না। আমি বাহাদুরকে পাঠিয়ে অন্য রিক্সা আনিয়ে দিচ্ছি।
দীপ্তি অবাক হয়ে বলে, ও মা! কেন রে? তুই কি ভাবিস আমার বেড়ানোর খুব শখ হয়েছে? তোদের অখাদ্য শহর দেখার একটুও ইচ্ছে আমার নেই। আমি ওর রিক্সায় উঠতে চেয়েছি, সেটা একটা থ্রিলিং এক্সপেরিয়েন্স হবে বলে। ও চালাবে, আমি বসে বসে দেখব রাস্তায় ভদ্রলোকদের মুখগুলো কেমন হয়ে যায়।
কাঁদো কাঁদো মুখে বন্দনা বলল, কিন্তু ও তো রিক্সাওলা নয় দীপ্তিদি! ওরা যে ভদ্রলোক! ও অমন বিচ্ছিরি লোক বলেই রিক্সা চালায়।
তুই অমন অস্থির হচ্ছিস কেন? ওর প্রতিবাদটা বুঝতে পারছিস না? টের পাস না যে এটা ওর বিদ্রোহ? ভদ্রতার মুখোশ টেনে খুলে দিতেই তো চাইছে ও। আমি এরকম সাহসী ছেলে দেখিনি।
বন্দনা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘর থেকে দৌড় পায়ে বেরিয়ে এল। দুর্বল শরীর সইল না, বারান্দায় এসে সে উবু হয়ে বসে পড়ল মুখ ঢেকে। নীচে অতীশের রিক্সা যেন তাকে ঠাট্টা করতেই হর্ন দিচ্ছে। পক পক।
দীপ্তির ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে বন্দনার। দীপ্তিদি যেন কী!
সে হামাগুড়ি দিয়ে রেলিঙের কাছে এগিয়ে গেল।
নীচে অতীশ তার রিক্সায় বসে আছে। সেদিকে চেয়ে থেকে বন্দনা মনে মনেই বলল, তুমি একটা বিচ্ছিরি লোক।
অতীশ হঠাৎ উধ্বমুখ হয়ে বলে, তোমার দিদিকে তাড়াতাড়ি করতে বলো। মাত্র দু ঘণ্টার কড়ারে রিক্সা এনেছি। বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে গণেশকে রিক্সা ফেরত দিতে হবে।
রাগ করে ঘরে এসে শুয়ে রইল বন্দনা। তার রাগ হচ্ছে, তার অপমান লাগছে। আজকের দিনটা তার ভাল যাচ্ছে না। শুয়ে শুয়েই সে শুনতে পেল দীপ্তিদির হালকা চটির শব্দ চটুল গতিতে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। রিক্সা দুবার হর্ন দিল, পক পক।
ঘরের মধ্যে কান্না পাচ্ছে বন্দনার। হাঁফ ধরে যাচ্ছে, আজ কী ভীষণ খারাপ একটা দিন।
শরৎশেষের সকালবেলায় চমৎকার একটা সোনালি আলো পাঠালেন ভগবান। সেই আলোর সঙ্গে পাঠালেন শিরশিরে উত্তুরে হাওয়া। আলো হাওয়ায় মাখামাখি হয়ে চারদিকে নানা কাণ্ড ঘটতে লাগল। বাগানে গাছের ছায়ায় বেতের চেয়ারে বসে বন্দনা দেখছিল। মনে মনে নানা কথা, নানা উল্টোপাল্টা চিন্তা। বাবার চিঠিটা সে কতবার পড়েছে তার ঠিক নেই। শরৎ রচনাবলীর মধ্যে যত্ন করে রাখা চিঠিটা আবার বের করল। সস্তা খাম, এক্সারসাইজ বুক থেকে ছিঁড়ে-নেওয়া পাতায় ডট পেন দিয়ে লেখা। চিঠিটার চেহারাই এমন গরিবের মতো যে, কষ্ট হয়। লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে লেখা বাবার এই চিঠির ভিতর দিয়েই সে এই অকরুণ পৃথিবীকে খানিকটা বুঝে নিচ্ছিল।
বাবার চিঠিটা আর একবার খুলে পড়তে যাচ্ছিল বন্দনা, এমন সময়ে হঠাৎ সামনে যেন মাটি খুঁড়ে একটা ছেলে উঠে দাঁড়াল। এমন চমকে গিয়েছিল বন্দনা।