বিলু হঠাৎ বলল, বাবা কী চাকরি করে?
একটা কারখানায় কী যেন করে। সামান্য কাজ।
বিলু আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, তোকে কাঁদতে দেখে আমি ভেবেছিলাম বাবা বুঝি মরেটরে গেছে।
যাঃ। কী যে বলিস!
বিলুও উঠে কলঘরে গেল। পড়ার টেবিলে চুপ করে বসে রইল বন্দনা। তার সামনে সমস্যাটা যেন একবোঝা জট-পাকানো উল। তাতে গিট, ফাঁস, জড়িয়ে মুড়িয়ে একশা। বাবা, মা, রমা মাসি এই তিনজন মিলে কী যে একটা পাকিয়ে তুলল!
বাবুদা এল সাড়ে আটটা নাগাদ। ছিপছিপে লম্বা চেহারা। পরনে ধুতি আর সাদা শার্ট। বাবুদাকে প্যান্ট ট্যান্ট পরতে কখনও দেখেনি বন্দনা। মুখখানা সর্বদাই ভদ্রতায় মাখা। সবসময়ে নরম গলায় কথা বলে। কথাবার্তায় শিক্ষা আর রুচির ছাপ আছে। বাবুদা একা নয়, সঙ্গে কয়েকটা ছেলে। এ বাড়ির আজকাল আর আগল নেই। বাবুদা সোজা ওপরে উঠে এল।
বন্দনা দরদালানে লেনিনের ছবিটার নীচেই একটা চেয়ারে বসে একখানা শরৎ রচনাবলী পড়ার চেষ্টা করছিল। আজ মন বসছে না। মনটা বড্ড উড়ুউড়ু। মনটা বড় খারাপ। নইলে আজও সোনালি মিঠে রোদ উঠেছে। আজও সুন্দর দিনটি। শুধু বন্দনার চোখই সুন্দর দেখছে না কিছু।
বাবুদাকে দেখে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল সে। বাবুদা বলল, উঠতে হবে না। বোসো। তুমি খুব ভুগে উঠলে, না?
হ্যাঁ। আমার টাইফয়েড হয়েছিল।
খুব রোগা হয়ে গেছ।
হ্যাঁ।
মাসিমা কোথায়?
বাবুদাকে দেখলে বা কথাবার্তা শুনলে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে, গতকাল এই বাবুদাই দলবল নিয়ে ল্যাংড়াকে ঢিট করতে এসেছিল। কেউ বিশ্বাস করবে না এই বাবুদা কাল ওরকম সাঙ্ঘাতিক বোমাবাজি করে গেছে।
বন্দনা বলল, আপনি বসুন, মাকে ডাকছি।
মা রান্নাঘরে জলখাবারের তদারকি করছিল। মুখখানা ভার, বিষণ্ণ। সারা রাত মা ঘুমোয়নি, জানে বন্দনা।
মা, বাবুদা এসেছে। তোমাকে ডাকছে।
মা বিরক্ত হল। বলল, কী চায় বাবু?
তা জানি না।
মা আঁচলে হাতটা মুছতে মুছতে বলল, যা, যাচ্ছি।
মা আসতেই বাবুদা চেয়ার ছেড়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।
কেমন আছেন মাসিমা?
আমি ভাল নেই। বড় অশান্তিতে আছি। কিছু বলবে?
হ্যাঁ মাসিমা। কাল ল্যাংড়া আর তার দলের ছেলেরা ও বাড়ির ভিতর থেকে বাইরে আমাদের ওপর বোমা মেরেছে।
জানি।
ও নাকি এখানে একটা ডেরা করেছে?
তা করেছে।
আমাদের সেটা কেন জানাননি মাসিমা? জানালে আমরা কবে ওকে সরিয়ে দিতাম।
কাকে বারণ করব বলো তো? আজকাল আমার বাগানে কত লোক সারাদিন ঢোকে। নারকেল পেড়ে নিয়ে যায়, গাছ থেকে ফল নিয়ে যায়, ফুল নিয়ে যায়। এমনকী আজকাল ছাগলও বেঁধে রেখে যায় দেখছি। দেয়াল সারালে হয়তো হয়। কিন্তু তার অনেক খরচ। মিস্ত্রিরা বলে গেছে ত্রিশ ফুট দেয়াল ভেঙে ফেলে নতুন করে গাঁথতে হবে।
সেটা পরের কথা। ল্যাংড়া যাতে এখানে কতে না পারে তার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আপনি পারমিশন দিলে আমাদের দলের কয়েকটা ছেলে পালা করে পাহারা দেবে। তারা ভাল। ছেলে।
মা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, পাহারা দেবে?
আপনার আপত্তি থাকলে নয়। আপনাদের পিছনের দিকের ফাঁকা গোয়ালঘরটায় বসেই বোধহয় ওরা বোমা বাঁধে।
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এ বাড়ি কি রক্ষা হবে বাবু? বড্ড ভয় পাচ্ছি।
আমাদের জানালে এত কাণ্ড ঘটত না।
বড় বাড়ির অবস্থা কি আর তোমরা জানো না। দুটো নাবালক ছেলেমেয়ে, বুড়ো মালি, বাহাদুর আর মদনকে নিয়ে থাকি। আমাদের সহায়-সম্বল তো কিছু নেই। কাল কিন্তু বাইরে থেকেও বাড়ির ভিতরে বোমা পড়েছে।
জানি মাসিমা। কাজটা উচিত হয়নি। আমি ক্ষমা চাইছি। তা হলে অনুমতি দিচ্ছেন?
তোমার দলের ছেলেরা আবার অশান্তি করবে না তো? ধরো যদি ল্যাংড়া ঢুকতে চায় তবে তারা হয়তো মারদাঙ্গা করবে।
না মাসিমা। ল্যাংড়া বাড়াবাড়ি করলে তারা গিয়ে শুধু আমাদের খবর দেবে।
তাতে যদি আমাদের ওপর ল্যাংড়ার আক্রোশ হয়?
অত ভয় পাবেন না মাসিমা। গুণ্ডাবাজি খতম করার চেষ্টাই তো আমরা করছি। ল্যাংড়া ভয় পেয়ে পালিয়েছে। সে তেমন কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবু সাবধানের মার নেই।
দেখো বাবা, আমি কিন্তু খুব অসহায় মানুষ।
অসহায় কেন মাসিমা? আমরা তো আছি। আমরা সবাই প্রদীপের বন্ধু। প্রদীপের মতো সাহসী ছেলে কটা হয়? আপনি একজন সাহসী সৈনিকের মা।
মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল। আঁচলে চোখ চেপে ধরে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ঠিক আছে।
বাবু যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল তখন মা তাকে আবার ডাকল, বাবু, শোনো।
কী মাসিমা?
আমাকে সস্তায় একটা বাসার খোঁজ দিতে পারো? বাসা?
কেন মাসিমা?
আমার বড় দরকার। একখানা ঘর হলেও চলবে। কিন্তু ভাড়া বেশি যেন না হয়। তুমি তো অনেককে চেনো, একটু খোঁজ নেবে?
ঠিক আছে।
খুব তাড়াতাড়িই চাই কিন্তু।
দেখব মাসিমা।
বাবু চলে যাওয়ার পর বন্দনা অবাক হয়ে বলল, কার জন্য বাসা খুঁজছ মা? কে থাকবে?
আমরা থাকব। তুই, আমি আর বিল।
কেন মা?
অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি তোর বাবাকে একটা চিঠি লিখব। বলব চলে আসুক সে। তার বাড়িঘর বুঝে নিক। সুখে থাকুক। আমি তার পথের কাঁটা, সরে যাব।
এত তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেললে মা? বাবা তো লিখেছে আমাদের জন্যও তার মন কেমন করে। তাই আসতে চাইছে।
তুই কিছু বুঝিসনি। আসল কথা, নিজের বাড়ি দখল চাইছে। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা লিখলেও আসল কথা হল তাই।