বন্দনার কাছে তার বাবা যা, মায়ের কাছে তো বাবা তা নয়। বাবা শত অপরাধ করে থাকলেও বন্দনার বুক ভরে আছে বাবার প্রতি ভালবাসায়। বাবার অপরাধ তার কাছে ক্ষমার যোগ্য মনে হয়। মায়ের কাছে তো তা নয়। তার মতো করে বাবাকে কেন যে ভালবাসতে পারে না মা সেইটেই বুঝতে পারে না বন্দনা।
অন্য পাশ ফিরে সে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। বাবার জন্য বড় ভার হয়ে আছে বুক। বাবা খেতে পায় না, বাবা বড় কষ্টে আছে। তার চোখ ভেসে যায় জলে।
মাও যে ঘুমোতে পারছে না তা টের পায় বন্দনা। মা ছটফট করছে। এপাশ ওপাশ করছে। উঠে উঠে জল খাচ্ছে।
মা আর বাবার কি আর কোনওদিন মিলমিশ হবে না ভগবান?
দীপ্তি অনেক বেলা অবধি ঘুমোয়। ভোরবেলা দুবার তার ঘরে গিয়ে ফিরে এল বন্দনা। আটটা নাগাদ যখন দীপ্তি উঠে ব্রাশে পেস্ট লাগাচ্ছে তখন গিয়ে বন্দনা তাকে ধরল।
আমাকে বাবার কথা একটু বলবে দীপ্তিটি?
দীপ্তি খুব সুন্দর করে হাসল। বলল, আয়, বোস। তোকে মামি কিছু বলেছে বুঝি?
হ্যাঁ। বাবার চিঠি পড়ে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবা বুঝি তোমাদের বাড়ি যায়?
আগে যেত না। মামা তো লাজুক মানুষ। একটা কেলেঙ্কারি করে ফেলায় খুব লজ্জায় ছিল। তবে ইদানীং যায়।
বাবার কি খুব কষ্ট দীপ্তিদি?
দীপ্তির মুখখানা উদাস হয়ে গেল। বলল, কষ্ট! সে কষ্ট তোরা ভাবতেই পারবি না। হাওড়ার একটা বিচ্ছিরি বস্তির মধ্যে একখানা ঘর ভাড়া করে আছে। অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে। বাথরুম নেই, কল নেই। রাস্তার কলে গিয়ে চান করতে হয়। বরোয়ারি পায়খানা। একদম নরক। যে ঘরে থাকে সেখানেই ভোলা উনুনে রান্নাবান্না। মামাকে দেখলে চিনতে পারবি না, এত রোগা হয়ে। গেছে। মাথার চুল প্রায় সবই উঠে গেছে। একটা লোহার কারখানায় কী যেন সামান্য একটা চাকরি করে, উদয়াস্ত খাটায় তারা। কী যে অবস্থা, দেখলে চোখে জল আসে।
শুনতে শুনতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছিল বন্দনা। বলল, আরও বলো দীপ্তিদি।
কেন শুনতে চাস? যত শুনবি তত কষ্ট। অমন একটা সুখী শৌখিন মানুষের যে কী দুর্দশা হয়েছে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
কাঁদতে কাঁদতে বন্দনা বলল আমাদের কথা বলে না?
বলে না আবার! তোদের কথা বলতে বলতে হাউ হাউ করে কাঁদে।
বন্দনার হিক্কা উঠছিল। বলল, আমাকে ঠিকানাটা দেবে দীপ্তিদি? ঠিকানা! সেই বস্তির কি ঠিকানা-ফিকানা আছে? থাকলেও ঘরের নম্বর-টম্বর তো জানি না। একদিন মামা আমাকে আর মাকে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটার মুখেভাত হল তো, আয়োজন টায়োজন কিছু করেনি। একটু পায়েস বেঁধে মুখে ছোঁয়াল। সেদিনই মাকে আর আমাকে নিয়ে গিয়েছিল জোর করে। বলল, আমার তো আর এখানে স্বজন কেউ নেই, তোরাই চল। তাই গিয়েছিলাম। গিয়ে মনে হল, না এলেই ভাল হত। বাচ্চাটাও হয়েছে ডিগডিগে লোগা। এত দুর্বল যে জোরে কাঁদতে অবধি পারে না।
বন্দনা আকুল হয়ে বলল, কী হবে বলো তো দীপ্তিদি?
পেস্ট মাখানো ব্রাশটা হাতে ধরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল দীপ্তি। তারপর বলল, মামি বোধহয় রাজি হবে না, না?
মা বলছে বাবা এ বাড়িতে এলে মা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।
সে তো ঠিক কথাই। এ তো আর আগের যুগ নয় যে, পুরুষমানুষরা দুটো-তিনটে বউ নিয়ে একসঙ্গে থাকবে। মামাকে আমি সে কথা বলেছি। একজনকে ডিভোর্স করো।
বাবা কী বলল?
মামা কাউকে ত্যাগ করতে পারবে না। বড্ড নরম মনের মানুষ তো, একটু সেকেলেও।
বন্দনা ধরা গলায় বলল, আমার বাবা বড্ড ভাল। কিন্তু বুদ্ধি নেই। ওই রমা মাসিই তো সব গণ্ডগোল করে দিল।
দীপ্তি বন্দনার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর তাই মনে হয়? আমার কিন্তু রমাকে খারাপ লাগেনি। খুব নরম সরম, খুব ভিতু আর ভদ্র। সে বারবার বলছিল, ভিভোর্স করলে আমাকেই করুক। আমাদের তো তেমন করে বিয়েও হয়নি। কালীঘাটের বিয়ে, ওটা না মানলেও হয়। কিন্তু রেণুদি তো ওঁর সত্যিকারের বউ। আমি রাক্ষসী, রেণুদির সর্বনাশ করেছি।
রমা মাসিকেই কেন ডিভোর্স করুক না বাবা।
দীপ্তি করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, সেটা কি খুব নিষ্ঠুরতা হবে না? রমা কোথায় যাবে বল তো! বাপের বাড়িতে গেলে ঝেটিয়ে তাড়াবে। আর তো ওর কেউ নেই। মামা ত্যাগ করলে ওকে ভিক্ষে করতে হবে। নইলে সুইসাইড।
বন্দনা একটু শিউরে উঠল। না, সে ওসব চায় না। রমা মাসিকে তার কখনও খারাপ লাগত না। শুধু বাবার সঙ্গে ওরকম হল বলে
দীপ্তি বলল, মামা কিছুতেই রমাকে ছাড়তে পারবে না। দুজনেই দুজনকে খুব ভালবাসে। অত অভাব, অমানুষিক কষ্ট, তবু ভালবাসে। এ যুগে এরকমটা ভাবাই যায় না।
এই ভালবাসার কথা শুনে বন্দনার একটুও ভাল লাগল না। বাবা কেন রমা মাসিকে এত ভালবাসছে? বাবার তো ভালবাসার কথা মাকে।
দীপ্তি বাথরুমে গেলে বন্দনা এল পড়ার ঘরে। অস্থির। এ ঘরে বিলু শোয়। এখনও ঘুমোচ্ছ পড়ে।
এই বিলু, ওঠ! উঠবি না?
কয়েকবার নাড়া খেয়ে বিলু উঠল।
কী রে দিদি? তুই কাঁদছিস কেন?
তোর বাবার কথা মনে হয় না?
বিলু অবাক হয়ে বলে, কেন হবে না? বাবার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি। বাবা এখন খেতে পায় না জানিস? খুব কষ্টে আছে।
কে বলল?
বাবার চিঠি এসেছে। দীপ্তিদি সব জানে।
বিলু ঘুম-ভাঙা চোখে একটু হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। ছেলে বলেই বোধহয় বিলু খানিকটা ভুলে থাকতে পারে। তার আছে বাইরের জগৎ, আছে খেলা, আছে নানা কৌতূহল। বন্দনার ততটা নয়। অসুখে পড়ে থেকে সে সারাক্ষণ বাবার কথা ভেবেছে। তার অসুখ হলে বরাবর বাবা এসে বিছানায় সারাক্ষণ পাশে বসে থাকত। বড় নরম মনের মানুষ।