পাছে ডাকে চিঠি মারা যায় এবং পাছে ডাকের চিঠির জবাব মা না দেয় এবং পাছে নিজের ঠিকানা রেণুকে জানাতে হয় সেই জন্যই চিঠিটা মেঘনাদ পাঠিয়েছেন দীপ্তির হাতে।
চিঠিটা নিয়ে মা গভীর রাতে বিছানায় এল। তাকে ডেকে বলল, পড়।
বন্দনা অবাক হয়ে চিঠিটা হাতে নিয়ে বলল, কার চিঠি মা?
তোর বাবার।
বাবা! গলায় যেন একটা আনন্দের ঝাপটা লাগল। বাবা চিঠি দিয়েছে! এর চেয়ে বড় খবর আর কী হতে পারে? চিঠিটা খুলল বন্দনা, তারপর ধীরে ধীরে পড়ল। প্রত্যেকটা শব্দ দুবার তিনবার করে। এ তার বাবার হাতের লেখা। এ চিঠিতে বাবার স্পর্শ আছে। আনন্দ আর বিষাদের একটা উথালপাথাল হচ্ছিল বুকের মধ্যে। চিঠি পড়তে পড়তে চোখ ভরে জল এল। বাবাকে কত কাল দেখে না বন্দনা! মা তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। কিন্তু চেয়ে থাকা আর দেখা তো এক জিনিস নয়। মায়ের দু চোখও ভেসে যাচ্ছিল জলে।
কত বড় অপমান বল তো? রমাকে নিয়ে এ বাড়িতে এসে থাকতে চাইছে। আমার চোখের ওপর! আমার নাকের ডগায়! এমন নির্লজ্জও হয় মানুষ!
কেঁদো না মা। কেঁদো না। বাবা তো লিখেইছে, খুব কষ্টে আছে।
কষ্টে তো থাকবেই। পাপের প্রায়শ্চিত্ত আছে না! বিনা দোষে আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে গেল, ছেলেমেয়ে দুটোর কথা পর্যন্ত ভাবল না একবার। প্রেমে এমন হাবুডুবু খাচ্ছিল যে নিজের মুরোদ কতটুকু তা অবধি মনে ছিল না। এখন তো কষ্ট পাবেই।
বাবাকে তুমি কী লিখবে মা?
কী লিখব? কিছু লিখব না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক। এ চিঠির আমি কোনও জবাব দেব না। ঠিকানাটা পর্যন্ত জানানোর সাহস হয়নি। পাছে আমি পুলিশ লেলিয়ে দিই। এই তো মুরোদ।
দীপ্তিদি বাবার ঠিকানা জানে না মা?
বলছে তো জানে না। সত্যি বলছে কি না কে জানে। হয়তো জানে, বলতে চাইছে না। ও হয়তো বারণ করে দিয়েছে।
দীপ্তিদি কি চিঠিটা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসেছে মা?
তাই তো মনে হচ্ছে, নইলে হুট করে আসবে কেন? এতদিন তো খোঁজখবরও নেয়নি। চিঠিটা হাতে দেওয়ার আগে অনেক নাটক আর ন্যাকামি করে নিল। রাতের খাওয়ার পর ওর ঘরে ডেকে নিয়ে কিছু মনে কোরো না মামি, রাগ কোরো না মামি এইসব বলে খুব মামার দুর্দশার ইতিহাস শোনাল। মামার খাওয়া জোটে না, রোগা হয়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে, বাজারে অনেক দেনা, এইসব। মামা নাকি আমাদের জন্য দিনরাত কাঁদে, বোনের কাছে গিয়ে দুঃখের কথা বলে। কত কী। এইসব ভূমিকা করে চিঠিটা বের করে দিল।
মায়ের কঠোর মুখখানার দিকে চেয়ে বুক শুকিয়ে গেল বন্দনার। তার মা কাঁদছে বটে, কিন্তু কাঁদছে ঘেন্নায়, আক্রোশে, অপমানে। বাবাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না মা। কিন্তু বন্দনার বুকটা ব্যথিয়ে উঠছে বাবার কষ্টের কথা জেনে। তার ভাবে ভোলা, কবির মতো মানুষ বাবা যে কখনও কোনও কষ্ট সহ্য করতে পারত না।
দীপ্তিকে কী বলেছে জানিস?
কী মা?
বলেছে চিঠিটা পড়ার সময় আমার মুখের ভাব কেমন হয় তা যেন ভাল করে লক্ষ করে। দীপ্তিই হাসতে হাসতে বলছিল। আরও বলল, মামা তোমাকে এত ভয় পায় যে তোমার কথা উঠলেই কেমন যেন ফ্যাকাসে আর নাভাস হয়ে যায়। এসব ন্যাকামির কথা শুনলে কার না গা জ্বলে যায় বল তো।
বন্দনা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, বাবা তো তোমাকে একটু ভয় পায় মা।
ছই পায়। ভয় পেলে আমার নাকের ডগায় রমার সঙ্গে ঢলাঢলি করতে পারত?
বন্দনা তার দুর্বল দুই হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাবাকে ছাড়া কত দিন কেটে গেল আমাদের বলো তো! বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। যদি সত্যিই না খেতে পেয়ে বাবা মরে যায় তখন কী হবে মা?
তার আমি কী করব? যদি এসে সত্যিই হাজির হয় তা হলে তো তাড়াতে পারব না। এ বাড়ি-ঘর তো তারই। আমি কে? যদি সত্যিই আসে তা হলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
দীপ্তিদিকে তুমি কিছু বলেছ মা?
এখনও বলিনি। কাল বলে দেব, ওর মামা ইচ্ছে করলে আসতে পারে। বিষয়-সম্পত্তির মালিক তো সে-ই। তবে যদি আসে তা হলে আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব।
কোথায় যাবে মা?
এ শহরে থাকার অনেক জায়গা আছে।
বন্দনা চুপ করে রইল। তারা কেউই অনেক রাত অবধি ঘুমোতে পারল না। ঈছাট বোমার আওয়াজ শুনল। পুলিশের জিপ কতবার টহল দিল পাড়ায়। মাঝে মাঝে কিট চেঁচামেচি হচ্ছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বন্দনা খুব নরম সতর্ক গলায় ডাকল, মা।
কী?
ধরা গলায় বন্দনা বলল, বাবার জন্য আমার মন বড় কেমন করছে মা। বাবাকে খু দেখতে ইচ্ছে করে।
মা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওই সর্বনাশীকে কেন যে ঘরে ঠাঁই দিয়েছিলাম! দীপ্তি বলছিল, রমার নাকি শরীর খুব খারাপ। হাঁফানিতে যদি মরত তা হলেও হাড় জুড়োত। কিন্তু শুনতে পাই হাঁফানির রুগিরা নাকি অনেককাল বাঁচে।
রমা মাসির মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠল বন্দনার। কী করুণ আর সুন্দর মুখখানা! রমা মাসি মরে গেলে কি খুশি হবে বন্দনা? একটুও না। রমা মাসি বেঁচে থাকুক, বাবা ফিরে আক, মা আর বাবার মিলমিশ হয়ে যাক হয় না এরকম? ভগবান ইচ্ছে করলে হয় না?
মা বলল, তার ওপর আবার বুড়ো বয়সে ছেলে হয়েছে। ঘেন্নায় মরে যাই। লজ্জা শরমের যদি বালাই থাকত। ফিরে তো আসতে চাইছে, এসে পাঁচজনকে মুখ দেখাবে কোন লজ্জায়? লোকে ছিছি করবে না? গায়ে থুথু দেবে না?