অতীশ গীর গলায় বলল, আলাপ হল।
বড়দি বলল, তবে মেয়েটার গুণও আছে। নাচ গান জানে, লেখাপড়া জানে। কলেজে পড়ায়।
মা বলল, অমন লেখাপড়ার মুখে আগুন।
ব্যাগটা উপুড় করল মা। তারপর জিনিসপত্রের দিকে চেয়ে থেকে বলল, এই দিল? চাল তো আধ কেজিও হবে না। এই নাকি ভুজ্যি? কাঁচা পেপে, ছটা আলু, উচ্ছে, দুটো বেগুন, আর দশটা টাকা মোটে দক্ষিণা! বড় বাড়ির নজর নিচু হয়ে যাচ্ছে। আগে কত দিত।
বড়দি বলল, কর্তামা আর পারে না। ওদের আয় কী বল তো!
নেই-নেই করেও আছে বাবা। পুরনো জমিদারদের কত কী লুকোনো থাকে।
কর্তামার নেই মা। তার দরাজ হাত। থাকলে কি বাড়ি বিক্রি করার কথা ভাবত?
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
যখন অনেক রাতে খাঁটিয়া নিয়ে ইস্কুলবাড়ির বারান্দায় শুতে যাচ্ছিল অতীশ তখনও ওই দুটো চোখ বার বার ছোবল দিচ্ছিল তাকে। একটা মৃদু বিষ নেশার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইছে। একটা ফিকে জ্যোৎস্ন উঠেছে আজ। চারদিক ভূতুড়ে। শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম এল না। মাঝরাতে দূরে বোমার শ শুনতে পেল, পুলিশের জিপ আর ভ্যান দ্রুত চলে গেল, কোথায় একটা সমবেত চিৎকার উঠল।
প্রদীপদা খুন হল রথতলার তেমাথায়। রাত তখন দেড়টা বা দুটো। তারা চারজন ছিল। প্রদীপদা, সে, দলের আর দুটো ছেলে। রথতলার তেমাথার কাছ বরাবর সুনসান রাস্তায় আচমকা অন্ধকার কুঁড়ে আট দশ জন ছেলে দৌড়ে এল বাঁ দিক থেকে। মুখে কালিঝুলি মাখা। হাতে রড, চপার, ড্যাগার। আত্মরক্ষার জৈব তাগিদের বশেই তাদের দলের দুটো ছেলে ছিটকে পালিয়ে গেল। প্রদীপ-গোঁয়ার প্রদীপ পালাল না। সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, অ্যাই, কী হচ্ছে? কী চাও তোমরা?
ব্যস, ওইটুকুই বলতে পেরেছিল প্রদীপ। পরমুহূর্তেই ঘিরে ফেলেছিল আততায়ীরা। চার-পাঁচ হাত পিছনে দাঁড়িয়ে শরীরে স্তন টের পেয়েছিল অতীশ। পালায়নি, কিন্তু সেটা বীরত্বের জন্য নয়। ভয় আর বিস্ময়ে তার শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছিল। যেমন দৌড়ে এসেছিল তেমনি দৌড়ে আবার অন্ধকারে পালিয়ে গেল ওরা। অতীশ খুব ধীরে, সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গেল প্রদীপের কাছে। প্রদীপের শরীর থেকে প্রাণটা তখনও বেরোয়নি। খিচুনির মতো হচ্ছে। শরীরটা চমকে চমকে উঠছে। গলা দিয়ে অদ্ভুত একটা গাৰ্গলের মতো শব্দ হচ্ছিল। রক্তে স্নান করছিল প্রদীপ। ওই রক্তের মধ্যেই হাঁটু গেড়ে বসে চিৎকার করছিল অতীশ, প্রদীপদা! প্রদীপদা!
একবার চোখ মেলেছিল প্রদীপ। কিন্তু সে চোখ কিছু দেখতে পেল না। তারপর ধীরে ধীরে খিচুনি কমে এল। শরীরটা নিথর হয়ে গেল।
গোটা মৃত্যুদৃশ্যটা প্রায় নিপলক অবিশ্বাসের চোখে দেখেছিল অতীশ। এইভাবে মানুষ মরে!
দলের ছেলেরা এল একটু বাদে। তুমুল চিৎকার করছিল তারা। রাগে, আক্রোশে। প্রদীপদাকে কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। তখন ঘাড় লটকে গেছে, হাতপাগুলো ঝুলছে অসহায়ের মতে, শরীরে প্রাণের লেশটুকু নেই।
বাবুদা তাকে ধরে তুলে নিয়ে এল সুবিমল স্যারের বাড়িতে। বলল, কী হয়েছিল সব বল।
প্রথমটায় কথাই এল না তার মুখে। জিভ শুকিয়ে গেছে, ভাষা মনে পড়ছে না। তাকে জল খাওয়ানো হল, চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হল। তারপর বলতে পারল হেঁচকি আর কান্না মিশিয়ে।
পুলিশ তাকে জেরায় জেরায় জেরবার করে ছেড়েছিল। কর্তামা তাকে জর্জরিত করেছিলেন বিলাপে, তুই ছিলি, তবু বাঁচাতে পারলি না ওকে? কীসের বন্ধু তুই? কেমন বন্ধু?… ওরে, সেই সময়ে কি একবার মা বলে ডেকেছিল? জল চেয়েছিল? নিরীহ মানুষ কতবাবু পর্যন্ত বন্দুক নিয়ে খুনিকে মারবেন বলে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কাকে মারবেন তিনি? আততায়ী কি একজন? পরে পুলিশ তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বন্দুক নিয়ে যায়।
সেই ঘটনার পর পলিটিকস থেকে সরে এল অতীশ। তারপর থেকেই সে একা হয়ে গেল। সংকীর্ণ করে নিল নিজের জীবনযাপনকে। পলিটিকস সে সত্যিকারের করেওনি কখনও। শুধু প্রদীপদার সঙ্গে লেগে থাকত বলে যেটুকু করা। তখন মাত্র উনিশ কুড়ি বছর বয়স, সেই বয়সে বুঝতও না কিছু।
পাড়ার মধ্যে একটা হুটোপাটির শব্দ পাওয়া গেল। একদল ছেলে দৌড়ে গেল সামনের রাস্তা দিয়ে। একটা কুকুর কেঁদে উঠল শাঁখের মতো শব্দ তুলে। একটা টর্চ জ্বলে উঠল কোথায় যেন। নিবে গেল ফের।
কাল সকালে উঠে একটু দৌড় প্র্যাকটিস করতে হবে। তারপর বেগুনের দাম তুলতে হবে। বাবার জ্বর না ছাড়লে আলুর দোকানে বসতে হবে। দুপুরে প্রগতি সংঘের স্পোর্টসে নামতে হবে। আর…আর.দীপ্তিকে রিলায় গপিয়ে শহর দেখাতে হবে।
কাছেপিঠে দুম দুম করে উপযুপরি দুটো বোমা ফাটল। একটা মস্ত হাই তুলল অতীশ। ঘুম পাচ্ছে। ইস্কুলবাড়ির খোলা বারান্দায় আজকাল গভীর রাতে বেশ ঠাণ্ডা লাগে। ভোর রাতে রীতিমতো শীত করে। গায়ে চাদরটা টেনে সে শুয়ে পড়ল। দুখানা মায়াবী, রহস্যময় চোখ তার দুচোখে চেয়ে রইল। ওই চোখ দুখানাই তাকে পৌঁছে দিল ঘুমের দরজায়। ঘুমের মধ্যেও যেন চেয়ে রইল তার দিকে। পলকহীন, হিপ্নোটিক।
৩. একটা খোকা হয়েছে
০৩.
তাদের একটা খোকা হয়েছে। তারা খুব কষ্টে আছে, অভাবের কষ্ট, মনের কষ্ট, ছেলেমেয়ের জন্য মন-কেমন করা। যদি ফিরে আসতে চায় তবে রেণু কি কিছু মনে করবে? এটুকু কি মেনে নিতে পারবে না? তারা না হয় নীচের তলায় স্টোর রুমে থাকবে, মুখ দেখাবে না। রমার হাঁফানি আবার বেড়েছে, কে জানে বাঁচবে কি না, ছোট খোকাটারও বড্ড অসুখ হয় ঘুরে ঘুরে। রেণু কি পারবে রমাকে একটু মেনে নিতে? জীবনের তো আর খুব বেশি বাকি নেই। কে কতদিনই বা আর বাঁচবে? আয়ু তো ফুরিয়েই আসছে। রেণু কি পারবে না সেই কথা ভেবে ক্ষমা করে নিতে?