তবু তো বেগুনের বস্তার কথা এরা জানে না।
ঘোষাল ঠাকুমা তার ডান হাতখানা ধরে আছে এখনও, ওসব তোর সইবে না রে ভাই। ছেড়ে দে।
ঘোষাল ঠাকুমা তার তেরো বছরের নাতনি সুচরিতার সঙ্গে অতীশের বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন। তার মায়ের কাছে প্রস্তাব গেছে। মা হেসে বলেছে, আপনার নাতনিকে আমার ছেলে খাওয়াবে কী মাসিমা? ছেলে আগে দাঁড়াক।
ঘোষাল ঠাকুমার দৃঢ় বিশ্বাস, অতীশ দাঁড়াবেই।
দাঁড়াতেই চাইছে অতীশ, তার মতো আরও বহু ছেলে ছোকরাও দাঁড়াতে চাইছে। দাঁড়াতে গিয়েই যত ঠেলাঠেলি আর হুড়োহুড়ি। পলিটিক্স করে বাবুদা দাঁড়িয়ে গেল, মস্তানি করে ল্যাংড়া। অতীশ কি পারবে? যে গলিপথ সে অতিক্রম করছে তার শেষে জয়মাল্য নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই, অতীশ। জানে।
কর্তামা পেতলের গামলায় সিন্নি মাখতে মাখতে মুখ তুলে বললেন, কী কাণ্ড হয়েছে জানিস? তোদের ওই ল্যাংড়া দলবল নিয়ে আমাদের বাগানের ভিতরে ঢুকে দেয়াল টপকে বাইরে বোমা মারছিল। উন্টে বাইরের ছেলেরাও ভেতরে বোমা ফেলেছে। কী কাণ্ড বাবা, ভয়ে দরজা জানালা এটে ঘরে বন্ধ হয়ে ছিলাম। গোপালটা বাগানেই থাকে। বুড়ো মানুষ, হার্টফেল হয়ে মারা যেতে পারত। মদন তাকে ভিতরবাড়িতে টেনে আনতে গিয়েছিল, এই বড় ছোরা নিয়ে মদনকে এমন তাড়া করেছে যে পালানোর পথ পায় না।
অতীশ চুপ করে রইল। এরকমই হওয়ার কথা।
কর্তামা করুণ মুখ করে বললেন, সন্ধেবেলা হীরেন দারোগা এসে কথা শুনিয়ে গেল। আমরা নাকি ষণ্ডাগুণ্ডাদের প্রশ্রয় দিচ্ছি। ঘটনা পুলিশকে জানাচ্ছি না। আমাদের বাড়িতে নাকি বোমা মজুত রাখা হয়। আজ আমি ঠিক করে ফেলেছি, বাড়ি বিক্রি করে দেব। শাওলরাম মাড়োয়ারি কিনতে চাইছে। ছেলে মেয়ে রাজি ছিল না বলে মত দিইনি। আজ ঠিক করে ফেলেছি। এত বড় বাড়ি ঝাড়পোঁছে কষ্ট, ট্যাক্সও গুনতে হয় একগাদা। আমাদের এত বড় বাড়ির দরকার কী বল!
দেয়ালটা সারালে হয় না কর্তামা?
সে চেষ্টাও কি করিনি। মিস্ত্রি বলল, দেয়াল ঝুরঝুরে হয়ে গেছে, ভাঙা জায়গায় গাঁথনি দিলে দেয়ালসুন্ধু পড়ে যাবে। মেরামত করতে হলে চল্লিশ ফুট দেয়াল ভেঙে ফেলে নতুন করে গাঁথতে হবে। তার অনেক খরচ।
জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নাইলনের ব্যাগে ভরে অতীশ যখন সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে তখন মেয়েটা সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়ে ডাকল, শুনুন!
অতীশ মুখ তুলে শ্যামলা মেয়েটিকে দেখতে পেল। ছিপছিপে চেহারা। চোখ দুখানা এত জিয়ন্ত যে তাকালেই একটা সমোহনের মতো ভাব হয়।
কিছু বলছেন?
আপনার সংস্কৃত উচ্চারণ কিন্তু খুব সুন্দর।
ও। তা হবে।
আপনি বোধহয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের একটু নকল করেন, তাই না?
অতীশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তা হবে।
তবু বেশ সুন্দর। আমি দীপ্তি। বন্দনার পিসতুতো দিদি।
ও। অতীশ আর তা হবে বলল না। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল অবশ্য।
আমি খুব বিচ্ছু মেয়ে। ভাব করলে টের পেতেন। কিন্তু আপনি যা গোমড়ামুখো, ভাব বোধ হয় হবে না।
আমি বড় সামান্য মানুষ। আমার সঙ্গে ভাব করে কী হবে? ভাব হয় সমানে সমানে।
তাই বুঝি। আমি কিন্তু জমিদারবাড়ির কেউ নই। সামান্য একজন অধ্যাপকের মেয়ে। আমার অত প্রেজুডিস নেই। আপনি কি নিজেকে খুব ছোট ভাবেন?
নিজেকে যে কী ভাবে অতীশ তা কি সে নিজেই জানে! কথাটার জবাব না দিয়ে সে একটু হাসল।
আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। কিন্তু আসতে না আসতেই কী কাণ্ড! শহরটা যে একটু ঘুরে দেখব তার উপায় নেই। আপনি আমাকে শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন?
আমি?
নয় কেন? আমার তো আর সঙ্গী নেই। বন্দনা সবে জ্বর থেকে উঠেছে, বিলু ছেলেমানুষ, মামিমার শরীর ভাল নয়। কে আমার সঙ্গী হবে বলুন তো! দেখাবেন প্লিজ?
কীসে ঘুরবেন? হেঁটে?
কেন, আপনার রিক্সায়!
মেয়েটা অপমান করতে চাইছে কি না বুঝবার জন্য অতীশ চকিতে তার দিকে তাকাল।
মেয়েটার মুখে একটু রসিকতা নেই। একটু ঝুঁকে চাপা আন্তরিক গলায় বলল, আপনি রিক্সা চালান জেনে আমি ভীষণ ইমপ্রেসড। মুভড়। এরকম সাহস কারও দেখিনি। আমি আপনার সঙ্গেই ঘুরতে চাই। রিক্সা চালিয়ে আপনি এই সমাজকে শিক্ষিত করছেন। আপনাকে শ্রদ্ধা করা উচিত।
অতীশের হাসি পাচ্ছিল। এত শক্ত কথা সে ভাবেনি। বলল, আচ্ছা।
কালকেই। সকালে যখনই আপনার সময় হবে। প্লিজ!
বাড়ি ফিরে যখন কুঁচকিতে গরম চুন-হলুদ লাগাচ্ছিল তখন অতীশ মাকে জিজ্ঞেস করল, ও বাড়ির দীপ্তিকে চেনো?
কে দীপ্তি? বন্দনার সেই পিসতুতো বোনটা নাকি?
হ্যাঁ।
বড়দি সেলাই করতে করতে বলল, পাজির পা ঝাড়া।
মা বলল, স্বামীটা তো ওর জ্বালাতেই বিষ খেয়ে মরল। একটা দু বছরের ছেলে নিয়ে বিধবা। স্বামী এক কাঁড়ি টাকা রেখে গেছে। পায়ের ওপর পা তুলে খাচ্ছে।
অতীশ অবাক হয়ে বলল, বিধবা? কই, দেখে মনে হল না তো!
মা একটু বিষ মেশানো গলায় বলে, মনে হবে কী করে? জেঁডেমুশে মাছ মাংস খাচ্ছে, রংচঙে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেন্ট পাউডার লিপস্টিক মাখছে, কুমারী না বিধবা তা বোঝার জো আছে।
বড়দি দাঁতে একটা সুতো কেটে বলল, চরিত্রও খারাপ।
মেয়েদের এই একটা দোষ। কারও কথা উঠলেই তার দোষ ধরে নিন্দেমন্দ শুরু করে দেবে। এ বাড়িতে সেটা খুবই হয়ে থাকে। মা আর দিদিদের প্রিয় পাসটাইম।
মা বলল, হঠাৎ ওর কথা কেন?