আজ হেমন্তের এই সকালে বন্দনা টের পাচ্ছে, তার চারদিককার আবহে একটা চোরা আনন্দের স্রোত। কেন? সে কি অসুখ থেকে উঠেছে বলে?
বন্দনা লেনিনের ছবিটার দিকে চেয়ে রইল। ওই ছবিটার দিকে তাকালে তার দাদার কথা মনে পড়ে। একটু কষ্ট হয়।
ঘর থেকে মা ডাকল, বন্দনা, কোথায় গেলি দুর্বল শরীরে?
এই তো মা আমি! বারান্দায়।
তার ফর্সা গোলগাল মা বেরিয়ে এল বারান্দায়, ওমা, তুই উঠে এসেছিস?
আজকের দিনটা কী ভাল, না মা?
আয় ফলের রস এনেছি।
এখানে এনে দাও।
ফলের রস বন্দনার ভাল লাগে না। তার কিছুই খেতে ভাল লাগে না। মায়ের ভয়ে খায়। তার মা দুঃখী মানুষ।
কিন্তু আজ দুঃখের দিন নয়। কী সুন্দর একটা দিন যে বন্দনাকে উপহার দিয়েছে এই পৃথিবী। আজ যেন স্বপ্নের আলো, স্বপ্নের বাতাস। আজ যেন কিছুই সত্যি নয়, সব রূপকথা।
সাদা পাথরের ভারী গেলাসে চুমুক দিয়ে সে ফলের রসেও একটা আলাদা স্বাদ পেয়ে গেল। ছোট্ট ছোট্ট তিনটে চুমুকের পর সে মুখ তুলে বলল, আজ আমগাছ তলায় একটু বসব মা?
মা তার দিকে চেয়ে বলে, আজ থাক না। দোতলা একতলা করতে কষ্ট হবে।
না মা, কষ্ট হবে না। কতদিন ঘরে পড়ে আছি বলো তো!
তা হলে দাঁড়া, বাহাদুরকে বলি ইজিচেয়ারটা পেতে দিতে।
একটু সাজবে কি বন্দনা? আজ যেন কয়েদখানা থেকে মুক্তি। অসুখের চেয়ে খারাপ কয়েদখানা আর কী আছে?
আয়নার সামনে নিজের পাঁশুটে চেহারাটার মুখোমুখি ফের দাঁড়ায় সে। খড়িওঠা মুখে একটু ক্রিম ঘসতেই মুখের রুগণতার রেখাগুলি ফুটে উঠল ভীষণ। কেন যে সে এত রোগা! এই শরীরে অসুখ হলে শরীর যেন হাওয়ায় নুয়ে পড়তে চায়।
এ শরীরে রং-চং মানাবে না বলে খুব হালকা গোলাপি রঙের একটা তাঁতের শাড়ি পরে নিল সে। চুল আঁচড়াল। তারপর পশমের টমেটো রঙা শালটা জড়িয়ে ধীরে ধীরে প্রকাণ্ড হলঘর পেরিয়ে দরদালানে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল সে। পাথরে বাঁধানো চওড়া সিঁড়ি, লোহার কারুকাজ করা রেলিং। আজ মনে হচ্ছে, কতদূর নেমে গেছে সিঁড়ি, সে কি পারবে এত সিঁড়ি ভাঙতে? মাঝ-সিঁড়ির চাতালে মস্ত শার্সি দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে। বাইরের আলোয় যেন নেমন্তন্নের চিঠি। এসো, এসো, আজ তোমার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি। আজ তোমার দিন।
পিছনের বাগানে কিছু পরিচর্যা আছে। বুড়ো মালি গোপাল এখন থুথুড়ে হয়ে গেছে। তার বাঁকা কোমর সোজা হতে চায় না, হাত কাঁপে, কানে শুনতে পায় না, চোখেও ছানি। তবু সে পিছনে একটুখানি জায়গায় মায়ের পুজোর জন্য ফুল ফোঁটায়। বাকি অনেকটা জমি ফাঁকা পড়ে আছে, আগাছা আর ঘাসের জঙ্গল।ঘের-দেয়াল দৃ জায়গায় ভেঙে গেছে বলে আজকাল গোরু মোষ ঢোকে, চলে আসে পথবাসী কুকুর। গোপালের বাগানের জন্য ছোট্ট একটু চৌখুপি জায়গা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে মা। এর বেশি গোপাল আর পারে না।
সেই চৌখুপি জায়গার মুখোমুখি পুরনো আমগাছের ছায়ায় ইজিচেয়ার পাতা হয়েছে।
উৎসবের বাড়িতে গেলে যেমন সবাই আসুন বসুন করে আজ বন্দনা বাইরে পা দেওয়ামাত্র যেন নিঃশব্দে চারদিকে একটা অভ্যর্থনা হতে লাগল তার। খোলা বাতাস তার কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল। বোদ জাপটে ধরল তাকে আদরে। কতদিন পর তার এই একটুখানি বাইরে আসা।
এ তার আজন্ম চেনা বাগান, চেনা গাছ। এই বাড়ির মতো এত প্রিয় জায়গা এ পৃথিবীতে কোথাও নেই তার। এ বাড়ি ছেড়ে সে কোনওদিন কোথাও যেতে পারবে বলে মনে হয় না। কত মায়ায় যে মেখে আছে বাড়িটা। মেঘলা দিন বা গ্রীষ্মের দুপুরে, শীতের সন্ধে বা নিশুত রাতে এ বাড়িটা নানারকম রূপ ধরে।
বাড়িটা অবশ্য এখন আর সুন্দর নেই। ছাদের গম্বুজগুলো ভেঙে পড়ে গেছে, নোনা আর শ্যাওলা ধরেছে দেয়ালে, অশ্বথের চারা উঁকি দিচ্ছে এখানে সেখানে। কতকাল মেরামত হয়নি, কলি ফেরানোনা হয়নি। তবু আজও এই গম্ভীর বাড়ি চারদিকটাকে যেন শাসনে রাখে। লোকে এখনও ভক্তি শ্রদ্ধা করে এসব বাড়িকে। মলি বলে, তোদের বাড়িটা ফিউডাল হলেও বেশ কমফোর্টেবল। স্পেস একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর। আমাদের বাড়িতে স্পেস নেই বলেই যত গণ্ডগোল। যত ঘেঁষাঘেষি হবে, মানুষে মানুষে, তত বেশি ক্ল্যাশ হবে, মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হবে, কেউ কাউকে সহ্য করতে পারবে না। স্পেস একটা মস্ত বড় সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর। সেদিক দিয়ে তোদের বাড়িটা দারুণ ভাল। বিগ হাউস, বিগ স্পেস, আইসোলেশন। গুড। ভেরি গুড। আমি ছেলেবেলা থেকে একটা আলাদা ঘরে একা থাকার স্বপ্ন দেখি। কী রকম ক্রাউডেড বাড়িতে আমরা থাকি বল তো। ওরকমভাবে থাকলে মানুষের ইমাজিনেশন মরে যায়, গুড কোয়ালিটিজ নষ্ট হয়ে যায়, সবচেয়ে বেশি হয় মেন্টাল ডিস্ট্যাবিলাইজেশন।
বন্দনা কথাটা কি স্বীকার করে? সে কখনও মলির মতো ক্রাউডেড বাড়িতে থাকেনি। তাদের বাড়িতে মানুষ খুব কম। তবু এ বাড়িতে কি অশান্তির অভাব? এই চুপচাপ বাড়ির ভিতরেও নিঃশব্দে ছিঁড়ে যায় কত বাঁধন, নিশুত রাতে কত চোখের জলে ভিজে যায় বালিশ, বুকের ভিতর কত তুষের আগুন জেগে থাকে ধিকিধিকি। এই গম্ভীর শান্ত বাড়ির বাইরে থেকে কি তা বোঝা যায়?
আজ দুঃখের দিন নয়। আজ এই রোদে হাওয়ায় বসে থাকতে বন্দনার কী ভালই না লাগছে, উড়ে যাচ্ছে দিন। নীল আকাশে সাদা হাঁসের মতো ভেসে যাচ্ছে হালকা পাখায়। আনন্দে দম নিতে মাঝে মাঝে কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভিতরটা ডগমগ করছে। এমন দিনে কি দুঃখের কথা ভাবতে হয়।