প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কটা আর কাটিয়ে উঠতে পারল না তারা। এখনও বড় বাড়ির হুকুম হলে তারা সব করতে পারে। মেঘনাদ চৌধুরি তার শালিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মাসোহারা উঠে গেছে। তবু এক অদৃশ্য নিয়মে এরা এখনও তাদের প্রভুই। এইসব সামন্ত প্রভুর স্বরূপ চিনিয়ে দিতেই তো বাবুদা মার্কসবাদের পাঠশালা খুলেছিল। অতীশ শিখেওছিল অনেক, কিন্তু তাতে কাজ বিশেষ হয়নি। আজও বড় বাড়িতে ঢুকতে ঘাড় নুয়ে পড়ে। স্মৃতি খারাপ জিনিস, শ্লথ করে দেয় মানুষকে, ব্যাহত হয় গতি, তবু বড় বাড়িতে ঢুকলেই দামাল সব স্মৃতি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাগানটা খুব আস্তে আস্তে পার হল অতীশ।
সামন্ততান্ত্রিক সিঁড়িটার গোড়ায় এসে ঊর্ধ্বমুখ হল সে। কেন যে এত উঁচু উঁচু বাড়ি বানাত সে আমলের লোকেরা! একতলা থেকে দোতলায় উঠতেই যেন হাজারটা সিঁড়ি। গুনতিতে হাজার না হলেও টাটালে কুঁচকি নিয়ে উঠতে হাজারটারই পেরানি পড়ে যাবে।
বন্দনা দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মাথায়। এত রোগা, সাদা আর বিষয় হয়ে গেছে এ যেন বাস্তবের বন্দনা নয়, অনেকটাই বিমূর্ত, তাকে দেখেই বন্দনা ঝঙ্কার দিল, এতক্ষণে আসার সময় হল! মা সকাল থেকে উপোস করে বসে আছে। কাণ্ডজ্ঞান বলে যদি কিছু থাকে তোমার! মা, ওমা, দেখ শাঁখ বাজাবে না উলু দেবে। তোমার পূজনীয় পুরুত ঠাকুর এসে গেছে।
বাকি সিঁড়ি কটা নিজেকে হিঁচড়ে টেনে তুলতে দম বেরিয়ে গেল অতীশের। উঠে খানিকক্ষণ হাঁফ সামলাল। কাল স্পোর্টসের মাঠে এই কুঁচকি তাকে কতটা বহন করবে কে জানে!
বড় বাড়ির পুজোর ঘরটি চমৎকার। আগাগোড়া শ্বেত পাথরে বাঁধানো মেঝে, মস্ত কাঠের সিংহাসনে বিগ্রহ বসানো, সামনে পঞ্চপ্রদীপ, ধূপ। স্থলপদ্ম আর শিউলির গন্ধে ম ম করছে চারদিক। পুরুতের জন্য মস্ত পশমের আসন পাতা।
তার ভিতরে দুজন লোক ঢুকে বসে আছে। রাখাল ভট্টাচার্য আর কার্ল মার্কস। যখন মার্কসবাদের পাঠশালায় পাঠ নিত তখন থেকেই তার ভিতরে এই দুজনের ধুন্ধুমার লড়াই। কখনও এ ওকে ঠেসে ধরে, কখনও ও একে পেড়ে ফেলে। মাঝে মাঝে লড়াই এমন তুঙ্গে ওঠে যে কে কোন জন তা চেনাই যায় না। কেউ হয়তো কার্ল ভট্টাচার্য হয়ে যায়, কেউ হয়ে যায় রাখাল মার্কস। এই দুজনের পাল্লায় পড়ে সে হয়েছে একটি বকচ্ছপ। আস্তিক না নাস্তিক তা বোৰা দুস্কর।
আচমন সেরে সে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, যজ্ঞ হবে নাকি কর্তামা?
কর্তামা পাটায় চন্দন ঘষতে ঘষতে বললেন, হবে না মানে?
হবে? ডোবালে। বসতেই কুঁচকি আর এক দফা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে। এই প্রবল অস্বস্তি নিয়ে কতক্ষণ টানা যায়?
এই দুর্দিনেও পাড়া ঝেটিয়ে বুড়োবুড়ি এসে জুটেছে। মস্ত ঠাকুরঘরে দেয়াল ঘেঁসে সার সার আসনে তারা বসা। সব ক জোড়া চোখ তার দিকে। পুজোয় ফাঁকি দেওয়ার জো নেই।
এই কি তোদর পুরুত নাকি রে বন্দনা? এ মা, এ তো বাচ্চা ছেলে। পারবে?
পারে তো! পুরুতেরই ছেলে।
তবু ভাই, পুরুত একটু বয়স্ক না হলে যেন মানায় না।
খুব সাবধানে মুখটা একটু ফিরিয়ে কোনাচে চোখে মেয়েটাকে একবার দেখে নিল অতীশ। শ্যামলা রং, কিন্তু মুখখানা ভারী সুশ্রী। চোখ দুটো একটু কেমন যেন। যেন এক জোড়া সাপ হঠাৎ বেরিয়ে এসে ছোবল দিল।
অতীশ উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্র পাঠ করতে লাগল।
রাখাল ভট্টাচার্য সংস্কৃত শিখেছিলেন টোলে। উচ্চারণটি নিখুঁত। অতীশ শিখেছে রাখাল ভট্টাচার্যের কাছে। সংস্কৃত মন্ত্রের একটা গুণ হল, উচ্চারণ ঠিক হলে আর কণ্ঠস্বরে সঠিক সুরের একটা দোল লাগাতে পারলে আজও হিপ্নোটিক। শুধু গরিব কেন, বড়লোকেরও আফিং।
আফিংটা ক্রিয়া করছে নাকি? ঘরটা হঠাৎ চুপ মেরে গেল! গলাটা উঁচুতেই তুলেছে অতীশ। রাখাল ভট্টাচার্য এইরকমই শিখিয়েছে তাকে। মন্ত্র উচ্চগ্রামে পাঠ করতে হয়, তাতে বাড়ির সর্বত্র মন্ত্রের শব্দ পৌঁছয়, তাতে বায়ু পরিশ্রুত হয়, জীবাণু নাশ হয়, অমঙ্গল দূর হয়। মন্ত্রের অত শক্তি আছে কি না জানে না অতীশ। আছে কি নেই বিচার করার সে কে? তার কাজ হল করে যাওয়া। ভাল যদি কিছু হয় তো হোক।
যজ্ঞ শেষ করে শান্তিজল ছিটিয়ে অতীশ উঠল। ঘোষাল ঠাকুমা ভিড় সরিয়ে এগিয়ে এসে এক গাল হেসে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কী পুজোটাই করলি দাদা আজ! স্বচক্ষে দেখলুম ঠাকুর যেন নেমে এসে সিংহাসনে বসে হাসছেন।
বটে ঠাকুমা? বলে অতীশ একটু হাসল।
তোর ওপর কি আজ ভর হয়েছিল দাদা?
তা হয়তো হবে। কত কী ভর করে মাথায়।
ও দাদা, তুই বি কম পাশ এত ভাল পুরুত, ভদ্রলোকের ছেলে, তার ওপর বামুন, রিক্সা চালানোটা ছেড়ে দে না কেন দাদা! ও কি তোকে মানায়?
রিক্সা চালানোর কথা উঠলেই মুশকিল। কর্তামা নিজেও একদিন না জেনে তার রিক্সায় উঠেছিলেন। ভাড়া দেওয়ার সময় মুখের দিকে চেয়ে আঁতকে উঠলেন, তুই! তুই রিক্সা চালাচ্ছিস?
শ্রমের মর্যাদার কথা এদের বুঝিয়ে লাভ নেই। এরা বুঝবেন না। তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল অতীশ। কর্তামা রাগের চোটে কেঁদেই ফেললেন প্রায়। তুই না আমাদের পুরুত! ছিঃ ছিঃ, তোর রুচিটা কী রে?
তার এক সহপাঠিনী অনুকাও না জেনে তার রিক্সায় উঠেছিল। মাঝপথে হঠাৎ অতীশ রিক্সা চালাচ্ছে টের পেয়ে চলন্ত রিক্সা থেকে লাফিয়ে পড়ে শাড়িতে পা জড়িয়ে কুমড়ো গড়াগড়ি।