পাড়া কে দখল করল না করল তাতেও অতীশের কিছু যায় আসে না। বাবুদা লেখাপড়া জান, ভদ্র ছেলে। এ পাড়ায় ঘর নিয়ে সে একসময়ে মার্কসবাদের ক্লাস নিত। তখন অতীশও তার ক্লাসে নিয়মিত গেছে। অনেক নতুন কথা শিখিয়েছিল বাবুদা। অধিকাংশই অবশ্য অতীশের এখন মনে নেই। শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা, যৌথ খামার, শ্রমিক আর কৃষকের অধিকার ইত্যাদি। পরে পার্টির গুরুতর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মার্কসবাদের পাঠশালাটা উঠে যায়। সে পুরুতের ছেলে এবং পুজো আচ্চা করে বেড়ায় বলে বাবুদা কখনও টিটকিরি দেয়নি। বরং খুব আন্তরিকভাবেই বলত, পুজো করছ? ভাল করে করো। ওর মধ্যে কিছু আছে কি না খুঁজে দেখো ভাল করে। আমার কী মনে হয় জানো? ভগবানের চেয়ে অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট হল সমাজে নিজের স্থানটা আবিষ্কার করা।
নিজের স্থানটা আজও আবিষ্কার করতে পারেনি অতীশ যখন রিক্সা চালায় তখন ভাড়া নিয়ে কত হেটোমেটো লোকও কত অপমান করে, মারতে আসে, গাল দেয়। আবার যখন কোনও বাড়িতে পুজো করতে যায়, তখন কত বুড়িধুড়িও মাটিতে পড়ে পায়ের ধুলো নেয়। সবজির পাইকার তাকে জিনিসের ন্যায্য দাম দিতে গড়িমসি করে, আবার ভিক্টরি স্ট্যান্ডে যখন দাঁড়ায় তখন কত হাততালি পায় সে। সুতরাং এ সমাজে তার স্থানটা কোথায় তা স্থির করবে কী করে সে?
বিশু বলল, বাবু হুঙ্ক্ষতটা কেন করছে জানো?
না। কেন?
কিছুদিন আগে সুবিমল স্যার ল্যাংড়াকে ডেকে পাঠিয়ে বলে, তুই পার্টিতে চলে আয়, তা হলে পার্টি তোকে দেখবে। ল্যাংড়া মুখের ওপর না বলতে পারেনি। কিন্তু পরে বলে পাঠিয়েছে পার্টিতে যাবে না। স্বাধীনভাবে থাকবে। শালা বুদ্ধ আছে। পাটির সঙ্গে লাগলে উড়ে যাবে একদিন। আজ পালিয়ে বেঁচে গেছে, কিন্তু রোজ তো আর লাক ফেবার করবে না, কী বলো গুরু? বাবু ওকে ঠিক একদিন ফুটিয়ে দেবে। পার্টিতে গেলে দোতলা বাড়ি আর মোটরবাইক দুটোই হয়ে যেত।
ল্যাংড়ার আপাতত দুটো স্বপ্ন। একটা দোতলা বাড়ি করবে, আর একটা হোন্ডা মোটরবাইক কিনবে। পাড়ার সবাই সে কথা জানে। তার মানে এ নয় যে, এ দুটো হলেই ল্যাংড়া ভাল ছেলে হয়ে যাবে। তা নয়। আপাতত এ দুটো স্বপ্ন দেখছে, পরে আরও স্বপ্নের আমদানি হবে। অতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই বেকারির যুগে মস্তানিও একটা ভাল প্রফেশন। ল্যাংড়াকে আর চাকরির ভাবনা ভাবতে হয় না, ভাত রুটির চিন্তা নেই।
খড়কাটা কলের পাশেই মদন দাসের খুপরির সামনে মাতাল মদনকে পেটাচ্ছিল তার লায়েক ছেলে পানু। পেটানোটা যেন জুতমত হয় তার জন্য মদনের বউ নবীনা আর মেয়ে সুমনা তার দুটো হাত দুদিকে দিয়ে চেপে ধরে আছে। পিছন থেকে কোমর ধরে আছে ছেলে নয়ন। মদনের মুখ থেকে যেসব গালাগাল বেরোচ্ছে তার চেয়ে খারাপ কথা পৃথিবীতে আর অল্পই আছে। আগে মদনই মাতাল হয়ে ফিরে বাড়িসুদ্ধ লোককে পেটাত আর গাল দিত। আজকাল চাকা ঘুরে গেছে। ব্যাপারটা অতীশের খারাপ লাগে না। এ যেন অতীতের দেনা শোধ হচ্ছে। বিস্তর লোক দাঁড়িয়ে গেছে দৃশ্য দেখতে। চোখ ভিডিও ক্যামেরা কাম টেপ রেকডার। হাবিব তনবীরের নাটক পয়সা খরচা করে দেখতে যাওয়ার দরকার কি?
বিশু এখানেই কেটে গেল। অতীশ দাঁড়াল না। এগোতে লাগল। এই যে হাত পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, এগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় টেরই পাওয়া যায় না। কিন্তু এক একটা যখন বিগড়োয় তখন সেটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুতর ভি আই পি। কুঁচকির সঙ্গে একটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধে নামার চেষ্টা করছে অতীশ। হচ্ছে না। রবি ঠাকুরকে একবার কাঁকড়া বিছে কামড়েছিল। সেই অসহ্য ব্যথা ভুলবার জন্য রবি ঠাকুর শরীর থেকে মনকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। ফলে আর ব্যথা টেরই পেলেন না। মনকে শক্ত করতে পারলে হয়তো হয়। অতীশ মনে মনে জপ করতে লাগল, এটা আমার কুঁচকি নয়, এটা আমার কুঁচকি নয়…
একটু কমপ্রেস আর গরম চুন-হলুদ দিয়ে রাখবে আজ রাতে। দরকার হলে কাল স্পোর্টসের আগে একটাব্যথার ইনজেকশন নিয়ে নেবে। তারপর ব্যথা দুনিয়ে যদি বিছানায় পড়ে থাকতে হয় লেভি আয়।
বাড়ি ফেরা কথাটাই ক্রমে অর্থহীন হয়ে আসছে অতীশের জীবনে। বাড়ি একটা ঠেক মাত্র। অনেকটা রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমের মতো। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার জন্য গাড়ি বদল করা মাত্র। তাদের একখানা মাত্র ঘর, সাতটি প্রাণী, একটা চৌকি আছে, তাতে বাবা শোয়। আর বাদবাকি মেঝেতে মাদুর পেতে। তাতেও জায়গা হয় না। অতীশ রাতে শুতে যায় ইস্কুলবাড়ির বারান্দায়। তাদের কলঘর নেই, বারোয়ারি পায়খানা, স্নানের জন্য দূরের পুকুর অথবা রাস্তার কল। তবু বাড়ি ফেরার একটা নিয়ম চালু আছে। জানান দিয়ে যাওয়া যে, আমি আছি।
মেঝেতে মাদুরের ওপর উপুড় করা একটা কৌটোর মাথায় হারিকেন বসানো। সেই আলোয় গ বসিয়েছে পাঁচ জন, বড়দি কুরুশ কাঠিতে অডারি লেস বুনছে, ছোড়দি একটা সোয়েটারে ভিজাইন তুলছে, দুই ভাইবোন পড়ছে, মা চাল বাছছে, বাবা বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শোওয়া।
তাকে দেখে মা একটা শাস ফেলল। বোধহয় অনেকক্ষণ ওই উদ্বেগের স্বাসটি বুকে চেপে রেখেছিল।
কোথায় ছিলি?
গাঁয়ে গিয়েছিলাম।
বড় বাড়ি থেকে বাহাদুর এই নিয়ে তিনবার এল খোঁজ করতে।