হ্যাঁ।
সাত আটজনকে তুলে নিয়ে গেছে। ল্যাংড়া হাপিস।
ও।
ল্যাংচাচ্ছ কেন? কী হয়েছে?
ও কিছু নয়। একটু টান লেগেছে শিরায়।
ছেলেটা বিশু। বন্ধুমতো, একটু চামচাগিরিও করে তার। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, বাবু ঠিক এন্ট্রি নিয়ে নেবে, বুঝলে? আজ বড় বাড়ির অন্দরের গেট অবধি এসে গিয়েছিল। বহুত বোমাবাজি হয়েছে। ল্যাংড়া শেষ অবধি চাল বেয়ে বেয়ে দক্ষিণের খাবারে নেমে পালিয়ে যায়।
এসব অতীশকে স্পর্শ করে না। এসব যেন অন্য জগতের খবর। ওই জগতের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ নেই। তার জগৎ খুব ছো, সংকীর্ণ এই গলিটার মতোই। সে জানে অনেক ব্যথা বেদনা বাধা সয়ে তাকে গতি বজায় রাখতে হবে। আজ রাতে ব্যথাটা যদি কমে ভাল, নইলে কাল এই বিষব্যথা নিয়েই তাকে দৌড়ে নামতে হবে। হাততালি নয়, জয়ধ্বনি নয়। তাকে একটা দামি প্রাইজ পেতেই হবে। সকালে আদায় করতে হবে বেগুনের টাকা। তার অনেক কাজ। বাবু আর ল্যাংড়ার কাজিয়ায় তার কোনও কৌতূহল নেই।
তবে ল্যাংড়া ইস্কুলে অতীশের সঙ্গে একক্লাসে পড়ত। ভীষণ ভাব ছিল দুজনে। প্রায় সময়েই গলাগলি করে ফিরত। একসঙ্গে খেলে বেড়াত রাস্তায় রাস্তায়। একটা তফাত ছিল। রেগে গেলে ল্যাংড়া খারাপ গালাগাল দিত লোককে। অতীশের মুখে খারাপ কথা আসত না। দিনরাত পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা গালাগালি শুনে আসছে অতীশ জন্মাবধি। আজ অবধি শালা কথাটাও উচ্চারণ করতে তার সংকোচ হয়। ল্যাংড়া জলের মতো ওসব বলত। সিক্সে দুবার ফেল করে পড়া ছেড়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে তার অন্য লাইনে উত্থান হতে লাগল। তখন কালো গুণ্ডার যুগ। চোলাই আর জুয়ার ঠেক তত ছিলই তার। এইসব বস্তিতে যে সব ছোটখাটো মেশিনপত্র নিয়ে নানা ব্যবসা করে লোক তাদের কাছ থেকে তোলা নিত। বড় কালীপুজো করত, যেমন গুণ্ডারা করেই থাকে। ল্যাংড়া কিছুদিন কালোর সাকরেদি করেছিল। কিন্তু বড় হওয়ার ইচ্ছে তার বরাবর। কী কারণে কে জানে, কালোর সাকরে পন্টুকে টিউবওয়েলের ধারে এক রাতে খুন করল ল্যাংড়া। তুচ্ছ কারণই হবে। হয়তো খুনটা ছিল আত্মপ্রকাশের ঘোষণা। দিন তিনেক দু পক্ষের বিচ্ছিন্ন মারপিট চলল। তারপর কালো বেগতিক বুঝে পাড়া ছেড়ে পালাল। ল্যাংড়া লিডার হয়ে গেল। কালো ছমাস বাদে এল। মস্তানি করতে নয়, বোধহয় পেটের তাগিদে। আর বউ বাচ্চার টানে। ল্যাংড়া ভরসন্ধেবেলা ল্যাম্পপোস্টের নীচে তার গলায় ড্যাগার ঠেকিয়ে কথা আদায় করল। নিজের লেদ মেশিন আর কেরোসিনের দোকান ছাড়া অন্য কিছুতে মাথা গলাতে পারবে না। কালো রাজি হয়ে গেল।
এসব ঘটনায় অবশ্য কোনও অভিনবত্ব নেই। গুণ্ডাদের উত্থান পতন এভাবেই সর্বত্র হয়ে থাকে। হয়ত এতটা শান্তিপূর্ণভাবে নয়, হয়তো দু-চারটে খুনজখম হয়। ল্যাংড়া শুধু পাড়াই দখল করেনি, সে এখন শহরটাই দখল করতে চাইছে। হয়ে উঠতে চাইছে হিরো। খানিকটা হয়েছে। নইলে অপরূপা দিদিমণির মতো এম এ বিটি সুন্দরী মেয়ে ওর প্রেমে পড়ে?
গতবছর বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় খুব ঝামেলা হয়েছিল। প্রতিবারই হয়। মেয়েরা পরীক্ষায় বসলেই তাদের যত ভক্ত প্রেমিক, হবু প্রেমিক তাদের সাহায্য করতে এসে জোটে। প্রেমিকাদের ইমপ্রেস করতে অনেক দুঃসাহসী কাণ্ডও করে তারা। দেয়াল টপকে লাইন বেয়ে উঠে নকল সাপ্লাই, খাতা বাইরে এনে প্রশ্নের উত্তর লিখে ফের দিয়ে আসা ইত্যাদি। স্কুল কর্তৃপক্ষ জ্বালাতন হয়ে শেষে শান্তিরক্ষার জন্য ল্যাংড়াকে ডেকে এনেছিল। ল্যাংড়ার বীরত্ব, চেহারা এবং হয়তো আরও কিছু অপরূপা দিদিমণিকে একেবারে বিহ্বল করে ফেলল। ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়সের অপরূপা ল্যাংড়ার চেয়ে বছর তিন চারের বড়। ভাল ঘরের মেয়ে। বাবা সরকারি অফিসার ছিলেন, এখন রিটায়ার্ড, দাদা বাইরে কোথায় যেন প্রফেসর। শোনা যাচ্ছে, অপরূপা আজকাল ল্যাংড়াকে পড়াচ্ছে, সৎপথে আনার চেষ্টা করছে। বিয়েও খুব শিগগিরই।
এসব ঘটে যায় সিনেমার ছবির মতো। অতীশের কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। চারপাশে কত কী ঘটে যাচ্ছে, সেসবের মাঝখান দিয়ে তার জীবনটা চলেছে ঠিক যেন একটা সরু গলির মতো।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আজ দিদিমণি বাবুকে খুব রগড়ে দিয়েছে, বুঝলে?
তাই নাকি?
বোমবাজির আগে বাবু যখন বড় রাস্তায় পজিশন নিচ্ছিল তখন অপরূপা দিদিমণি রিক্সা করে এসে নামল। তখনই লেগে গেল। বাবু নাকি বলেছিল আপনি একজন শিক্ষিতা ভদ্রলোকের মেয়ে হয়ে ওরকম একটা নোংরা অশিক্ষিত গুণ্ডার সঙ্গে কী করে মেলামেশা করেন। দিদিমণি বহুত বিগড়ে গিয়ে চিল্লামিল্লি করতে লাগল, আপনি না মার্কসিস্ট! শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলে বেড়ান! কোন লজ্জায় বলেন?
প্রেমট্রেম নিয়ে মাথা ঘামায় না অতীশ। তবে তার মনে হল, প্রেম ব্যাপারটা হয়তো এরকমই।
বিশু বলল, অপরূপা দিদিমণি মেয়েছেলে না হয়ে পুরুষ হলে বহুত বড়া রুস্তম হত, বুঝলে গুরু? ল্যাংড়া লাগত না ওর কাছে। যখন বোমবাজি শুরু হল তখনও বেঁটে ছাতা নিয়ে বাবুকে তেড়ে মারতে যাচ্ছিল। তারপর কী করেছে জানো? থানায় গিয়ে বড়বাবুকে পর্যন্ত আখ দেখিয়েছে। বলেছে, বাবুর এগেনস্টে যদি কেস না লেখেন তো আমি চিফ মিনিস্টার আর প্রাইম মিনিস্টারকে জানাব। তারপরই তো পুলিশ নামল। নইলে ল্যাংড়ার যা অবস্থা করেছিল একদম কেরাসিন। বাবু আজই পাড়া দখল করে নিত।