পরান প্ল্যাটফর্মের বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে বিড়ি ধরাচ্ছিল। বলল, এলেন তা হলে?
অতীশ জবাব দিল না। ডান পাটা সামনে লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে থেবড়ে বসে গেল পরানের পাশে।
জল খাবেন তত বাইরের টিপলে খেয়ে আসুন। এখনও সময় আছে।
জলের কথায় সচকিত হল অতীশ। তাই তো! তার যে বুক পেট সব তেষ্টায় শুকিয়ে আছে! শরীরের নানা অস্বস্তির মধ্যে তেষ্টাটা আলাদা করে চিনতে পারছিল না এতক্ষণ।
সে উঠল। বড় কষ্ট উঠতে। দাঁড়াতে গেলেই ডান পাটা বেইমানি করে যাচ্ছে। নেংচে খুঁড়িয়ে সে স্টেশনের বাইরে এসে টিউবওয়েলটা দেখতে পেল। যখন জল খাচ্ছিল তখন কলকল শব্দ করে পেটের মধ্যে খোঁদলে জল নেমে যাওয়ার শব্দ পেল। বড় খালি ছিল পেটটা।
জল খেয়ে ফিরে এসে দেখে পরান দার্শনিকের মতো মুখ করে চুপচাপ বসে আছে। বিড়িটা শেষ হয়েছে।
আপনার কথাই ভাবছিলাম।
অতীশ একটু হাসল, কী ভাবলে?
ভাবছিলাম, আপনি মেলা কষ্ট করছেন। এতে মজুরি পোষাবে না। আমাদের পুষিয়ে যায় কেন জানেন? আমরা এইসবের মধ্যেই জন্মেছি। শরীর যে খাটাতে হবে তা জন্ম থেকেই জানি। আপনার তো তা নয়। কোথায় ভদ্রলোকের ছেলে চাকরিবাকরি করবেন, তা নয়, এই উবৃত্তি।
অতীশ ঠ্যাংটার কথা ভাবছিল। ডান পা গুরুত্ব কমের বেচাল। এই স্থায় শালাকে লাই দিলে মাথায় উঠবে। কিন্তু শাসনেই বা রাখা যায় কী করে তা বুঝতে পারছে না।
আপনার পায়ে হয়েছেটা কী?
অতীশ অবহেলার ভাব করে ঠোঁট উল্টে বলল, দৌড়াতে গিয়ে টান লেগেছে। ঠিক হয়ে যাবে।
পরান উঠে পড়ল। বস্তাটা দাঁড় করিয়ে বলল, উঠুন। গাড়ি আসছে।
সন্ধের মুখে নিজেদের স্টেশনে নেমেই অতীশ বুঝতে পারল, একটা কিছু পাকিয়েছে। স্টেশন চত্বরটা বড় থমথমে।
কী হল পরান?
কিছু একটা হবে। দোকানপাট বন্ধ মনে হচ্ছে।
বাইরে একটাও রিক্সা নেই। এ সময়ে মেলা রিক্সা থাকার কথা। রিক্সা থাকলে অতীশের সুবিধে হত। তার পয়সা লাগত না। এ শহরের অধিকাংশ রিক্সাওলাই তার বন্ধু।
একটু দমে গেল সে। ফের বস্তা মাথায় নিয়ে বাজার অবধি ল্যাংচাতে হবে।
পুলিশের গাড়ি গেল, দেখলেন?
দেখলাম।
বাবু আর ল্যাংড়ার মধ্যে লেগে গেল নাকি?
তা লাগতে পারে। চলো।
বাজারে মালটা গস্ত করা গেল না। বাজার বন্ধ। বাবু আর ল্যাংড়ার দলে বোমাবাজি হয়েছে। ছোরাছুরি চলেছে, পাইপগান আর রিভলভারও বেরিয়েছিল। সব দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাপারিরা। একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি হয়েছে।
এ সবই বাজারে এসে শোনা গেল। কয়েকজন বাজারের চত্বরে কুপি জ্বালিয়ে বসে তাস খেলছিল। তারাই বলল।
ভাগ্য ভাল যে বেগুনের বস্তাটা বাড়ি অবধি টেনে নিতে হল না। বাজারের চৌকিদারকে বলে মহাজনের দোকানের সামনে রেখে বাড়ি ফিরল অতীশ। টাকাটা আজ পেলে ভাল হত।
বাড়ির পিছন দিকটায় তাদের পাড়া। ল্যাংড়ার ঠেক। বড় রাস্তা থেকে বড় বাড়ির মন্ত নিরেট দেওয়াল ঘেঁসে সরু গলি দিয়ে ঢুকতে হয়। গলির এক পাশে বড় বাড়ির দেওয়াল, অন্য পাশে গরিবগুর্বোদের খোলার ঘর। কুলিকামিন, ঠেলাওয়ালা রিক্সাওলাদের বস।
অন্যান্য দিনের তুলনায় পাড়াটা আজ অন্ধকার আর নিঃঝুম। মানুষ ভয় পেয়েছে। আজকাল মানুষ সহজেই ভয় পায়। ঠ্যাং টেনে টেনে হাঁটছে অতীশ। ব্যথা বাড়ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে টেরই পাওয়া যায় না। কিন্তু যেই একটায় ব্যথা বা চোট হল তখনই সেটা যেন জানান দিতে থাকে। এই এখন যেমন ব্যথা-বেদনার ভিতর দিয়ে তার ডান পা জানান দিচ্ছে, ওহে, আমি তোমার ডান পা! বুঝলে? আমি তোমার ডান পা! খুব তে ভুলে থাকো আমায়, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছ তো!
অতীশ বিড়বিড় করে, পাচ্ছি বাবা, খুব পাচ্ছি। এখন বাড়ি অবধি কোনওক্রমে বয়ে দাও আমাকে। তারপর জিরেন।
কথাটা মিথ্যে। কারণ আগামী কাল প্রগতি সংঘের স্পোর্টস। বরাবর ওরা ভাল প্রাইজ দেয়! এবারও ভি আই পি সুটকেস, ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, হাতঘড়ি, টেপ রেকর্ডার ইত্যাদি প্রাইজ আছে। বিধান ভৌমিকের চিট ফান্ডের কাঁচা পয়সা প্রগতি সংঘের ভোল পাল্টে দিয়েছে। বিধান এবার সেক্রেটারি। তা ছাড়া বাবু মল্লিক আছে। গত বছর যে বিরাট ফাংশন করেছিল তাতে বোম্বে থেকে ফিল্ম আটিস্ট আর গায়ক-গায়িকাদের উড়িয়ে এনেছিল। অনেক টাকার কামাই। সেইসব টাকার একটা অংশ প্রগতি সংঘের পিছনে কাজ করছে। প্রগতি সংঘ এখন শুধু এই শহর বা মহকুমা নয়, গোটা জেলারই সবচেয়ে বড় ক্লাব।
অতীশের প্রাইজ দরকার। স্কুল কলেজে যত প্রাইজ সে পেয়েছে তার প্রায় সবই বেচে দিতে পেরেছে সে। কাপ-মেডেলগুলো তেমন বিক্রি হয় না, হলেও খুব নামমাত্র দামে। তবে অন্য সব জিনিস বেচলে কিছু পয়সা আসে। আজ রাতে পায়ে একটু সেকতাপ দিতে হবে। একটু মালিশ লাগাবে। সকালে একটু প্রাকটিস। তারপর দুপুরেই নামতে হবে ট্র্যাকে। সে এ তল্লাটের নামকরা দৌড়বাজ, সে পুরুত, সে একজন কায়িক শ্রমিক এবং একজন কমার্স গ্র্যাজুয়েট। তবু নিজেকে তার একটা বিস্ময়ের বস্তু মনে হয় না। মনে হয়, এরকম হতেই পারে।
এই ফিরলে গুরু? বলে অন্ধকারে একটা ছোকরা একটু গা ঘেঁসে এল।
নির্বিকার অতীশ বলল, হ্যাঁ।
খুব ঝাড়পিট হয়ে গেল আজ। রাস্তায় পুলিশ দেখলে না?