বা ধারের মাঠে নামতে হবে। সাবধানে নামবেন, জায়গাটা বড্ড গড়ানে। পিছলও আছে।
দুর্গমগিরি কান্তার মরু নয়, তবু তার মধ্যেই যে কত ফাঁদ পাতা দেখে অবাক হতে হয়। উঁচু পথ থেকে মাঠে নামবার জায়গাটা এমন খাড়াই যে, দেখলে ভয় করে। সরু একটা আঁকাবাঁকা নালার মতো। হাল্কা পায়ে নামা কঠিন নয়। কিন্তু বেজুত কুঁচকি, টনটনে ঘাড় আর বেগুনের বোঝা নিয়ে নামা আর এক কথা। আজ যেন সবটাই তার কাছে শক্ত লাগছে।
পরান নেমে গিয়ে দাঁড়াল। পিছু ফিরে দেখছে তাকে। কী দেখছে? ফুল প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট পরা ভদ্রলোকের ছেলেটা ছোটলোক হওয়ার কী প্রাণপাত চেষ্টা করছে দেখ। এ কোনওদিন ভদ্রলোকও হবে না, ভাল করে ছোটলোকও হতে পারবে না।
জন্মাবধি অতীশ ধার্মিক ও ঈশ্বরবিশ্বাসী। পুজোপাঠ ইত্যাদির মধ্যেই তার জন্ম। বাবার সঙ্গে সঙ্গে সে ছেলেবেলা থেকে পুরুতের কাজে পাকা হয়েছে। ওই ঈশ্বরবিশ্বাস আজও মাঝে মাঝে তার কাজে লাগে। এই যেমন এখন। সে ওই বিচ্ছিরি নালার মতো সর্পিল পথটা দিয়ে নেমে পড়ার আগে চোখ বুজে একবার ঠাকুর দেবতাকে স্মরণ করে নিল। জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করতে হয় অন্ধের মতো। বুদ্ধি বিবেচনা আত্মশক্তি তখন কোনও কাজেই লাগে না। তখন ওই বিশ্বাসটার দরকার হয়। কিন্তু জীবনে যত ঘসটানি খাচ্ছে অতীশ তত যেন বিশ্বাসটার রং চটে যাচ্ছে।
বেগুনের বস্তার ঠেলায় আর মাধ্যাকর্ষণের টানে নামাটা হল হড়হড় করে। টাল রাখা কঠিন। কুঁচকির সঙ্গে ডান হাঁটুও সঙ্গতে নেমে পড়েছে। ব্যথাটা আর এক জায়গায় নেই, গোটা পা-ই যেন গিলে ফেলছে ব্যগার কুমির।
তবু পড়ল না অতীশ। দৈব আর পুরুষকার দুটোই বোধ হয় খানিক খানিক কাজ করল। মাঠে নেমে পড়ার পর সে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে বলল, চল।
পরান আর কথা বাড়াল না। সামনে সামনে হাঁটতে লাগল। গত কালের বৃষ্টিতে ক্ষেতে কাদা জমে আছে। আলপথও খুব নিরাপদ নয়। তবে ক্ষেতের চেয়ে শুকনো।
আগে পরান পিছনে অতীশ। চলেছে। তেপান্তরের মাঠ ফুরোচ্ছে না। বোধ হয় ফুরোবেও না ইহজীবনে। পরান এগিয়ে যাচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে অতীশ। তার ডান পা আর যেতে রাজি নয়। টাটিয়ে উঠছে। ফুলে উঠছে কুঁচকি। ভাবনাচিন্তা ছেড়ে দিয়েছে অতীশ। চলছে একটা ঘোরের মধ্যে। শরীর নয়, একটা ইচ্ছাশক্তি আর অহংবোধই চালিয়ে নিচ্ছে তাকে।
শিখার গাড়ি যখন তার রিক্সাকে পিছন থেকে এসে মারল তখন ছিটকে পড়েছিল অতীশ। সেই পড়ে যাওয়াটা খুব মনে আছে তার। রিক্সা চালাচ্ছে নিশ্চিন্তমনে, আচমকা একটা পেল্লায় ধাক্কায় খানিকটা ওপরে উঠে গদাম করে পড়ে যাচ্ছিল সে, তার সঙ্গে রিটাও খানিক লাফিয়ে উঠল, তারপর পড়ল তার ওপরেই। তখন কিছুই করার ছিল না অতীশের। হাত পা বোধ বুদ্ধি সব যেন অকেজো হয়ে গেল। তখন সে যেন এই বেগুনের বস্তাটার মতোই এক জড় পদার্থ। ভাগ্যের মার যখন আসে তখন মানুষের কি কিছু করার থাকে? ডান কনুই, মাথা, কোমর কেটে ছড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যতটা হওয়ার কথা ততটা হয়নি।
কথাটা হল, এক একটা সময়ে মানুষের কিছুই করার থাকে না। শত বুদ্ধিমান, বিদ্বান, কেওকেটা মানুষও তখন গাড়ল-বুন্ধু-ভ্যাবাচ্যাকা।
শিখা নেমে এল গাড়ি থেকে। একটু অপ্রস্তুত। তবু বলতে ছাড়ল না, হর্ন দিয়েছি, শুনতে পাওনি?
তা শুনেছিল হয়তো। চালপট্টিতে হর্নের অভাব কী? থিক থিক করছে রিক্সা, টেম্পো, লরি। কোন হর্নটা শুনবে সে? জবাবটা মুখে এল না, মাথাটা বড্ড গোলমাল ঠেকছিল তখন। লোক জমেছিল মেলা। দুচারজন অতীশের পক্ষ নিলেও বেশির ভাগই অতুলবাবুর মেয়ের দিকে। হর্ন দেওয়া হয়েছিল, সুতরাং দোষ কী?
অতীশ ভাবে, গাড়িতে যেমন হর্ন থাকে, তেমনি ব্রেকও তো থাকে! একটায় কাজ না হলে আর একটা দিয়ে লোককে বাঁচানো যায়। মেয়েটা আনাড়ি ড্রাইভার, সে কথা কে শুনবে? ভাঙা রিক্সা যখন টেনে তুলছে অতীশ, তখন অতুলবাবুর মেয়ে গাড়িতে ফের স্টার্ট দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল।
ঘটনাটা বড্ড মনে আছে তার। ভোলা যাচ্ছে না। মনোজবাবু রাগ করে রিয়া কেড়ে নিলেন। সেই থেকে একরকম ঘর-বসা অবস্থা তার।
তেপান্তরের মাঠ পেরোচ্ছে দুজন। সামনে শুধু ধুধু ন্যাড়া ক্ষেত। সামনে আরও এগিয়ে গেছে। পরান। দূরত্বটা কি বেড়ে যাচ্ছে? হেরে যাচ্ছে নাকি সে? জীবন সংগ্রামে পিছিয়ে পড়ছে? কিন্তু তা হলে তার চলবে কী করে? খুঁড়িয়ে, লেংচে, হিঁচড়ে তাকে বজায় রাখতে হবে গতি।
বড্ড ঘাম হচ্ছে তার। শরৎকাল শেষ হয়ে এল। তেমন গরম কিছু নেই। পরানচন্দ্রেরও তেমন। ঘাম হচ্ছে না। মাঠের ওপর দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। তবু এত ঘামছে কেন সে?
দূরে ওই কি রেলবাঁধ দেখা যাচ্ছে? খেলনাবাড়ির মতো স্টেশন কি ওই ঝোপজঙ্গলে ঢাকা? পরানচন্দ্র এবার দাঁড়াল। তারপর ফিরল তার দিকে।
কেমন বুঝছেন?
ভাল। তুমি এগোও।
ডান কনুইয়ের কাছ বরাবর একটু শিরশির করছিল। আড়চোখে চেয়ে দেখল, একটা খুঁয়োপোকা বাইছে। বাঁ হাতের আঙুলে শুয়োটাকে চেঁছে ফেলে দিল সে। এবার চুলকুনি শুরু হবে। না, আর পারা যায় না যে!
তবু পেরেও যায় মানুষ। কামড়ে থাকলে মানুষ না পারে কী? অতীশও পারল। তবে কিনা যখন রেলবাধে উঠে স্টেশনের চত্বরে এসে বস্তাখানা নামাল তখন তার মাথাটা একদম ডোম্বল হয়ে গেছে, ঠিক যেমন শিখার গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়ে হয়েছিল সেদিন।