পরানের সঙ্গে তার তফাত হল, পরানের রাস্তাটা সিধে। সে গাঁয়ে গঞ্জে বন্দোবস্ত করে আসে। হপ্তায় হপ্তায় গিয়ে মাল খরিদ করে আনে। তারপর বেচে। তার ওইতেই হয় বা চলে যায় বা চালিয়ে নিতে হয়। আর অতীশের হচ্ছে দু নৌকো সামাল দিয়ে চলা। তারা বামুন, গরিব। অথচ ভদ্রলোকও। সে যে বিকম পাশ এটা আর এক ফ্যাকড়া। তাই পরানের মতো তার রাস্তা তত সরল নয়।
অতুলবাবুর মেয়ে শিখা গাড়ি চালাচ্ছিল। স্টেশনে একটা ট্রিপ মেরে সওয়ারি নিয়ে ফিরছিল অতীশ। সে ঠিক জানে শিখা লাইসেন্স পেলেও হাত এখনও ঠিক হয়নি। চালপট্টির মধ্যে সরু রাস্তায় শিখার গাড়ির বনেট তার বাঁ দিকের চাকায় লেগে রিক্সা উল্টে দিল। শিখা বাচ্চা মেয়ে, তার দোষ দেয় না অতীশ। কিন্তু দোষ বাড়ির লোকের, কেন ওইটুকু মেয়ের হাতে গাড়ি ছেড়ে দেয়? রিক্সাটা গেল ভোগে! সওয়ারি একটা যুবক ছেলে, অ্যাকসিডেন্টের সময় চটপট লাফ মেরে নেমে গিয়েছিল। তার লাগেনি। হইহই হল বটে, কিন্তু অতুলবাবুর মেয়ে বলে কথা! তার সাত খুন মাপ।
রিক্সা ভাঙায় মনোজবাবু রেগে আগুন। রিক্সা বন্ধ হয়ে গেল। পরান বলেছিল, যান না, অতুলবাবুর কাছে একবার গিয়ে দাঁড়ান। ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু দিলেও দিতে পারে।
ওসব করে কী হবে? দুপচটা কটু কথা বলবে বোধহয়। দয়া করে যা দেবে তাতে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ। থাকগে।
বামুন তো, বুদ্ধি আর কত হবে? আমরা হলে আদায় করে ছাড়তাম।
ওইটেই মুশকিল। সে পরান নয়, আবার পরানের চেয়ে উঁচুও নয় পয়সার দিক দিয়ে।
দু পুরুষ ধরে ভাঙনটা শুরু হয়েছে। বাবাই প্রথম ভদ্রলোকের মুখোশটা খুলে বাজারে আলুর স্টল খুলেছিল। আলু বিক্রি বারো মাস। দরও বাঁধা। আয়ও বাঁধা। গলায় পৈতে নিয়ে তার বাবা পঁচিশ বছর আলু বেচছে, আবার পালপার্বণে পুজোও করে আসছে। তাতে সংসারের সুসার কিছু হয়নি। তারা খোলার ঘরে ভাড়া থাকে। কোনওরকমে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হয়ে যায়।
অতীশের বড় দুই দিদির কারও চাকরি হয়নি। ঘরে বসে পোশাক তৈরি করে বিক্রি করে। ছোট এক ভাই আর বোন স্কুলে পড়ে।
স্কুলে কলেজে অতীশ ভাল দৌজাজ বলে নাম করেছিল। ক্লাস থ্রি থেকে সব ফ্ল্যাট রেসে ফাস্ট। ফিনফিনে পাতলা শরীরে সে যে এত ভাল দৌড়োয় তা তাকে দেখলে বিশ্বাস হয় না। অতীশের খুব ইচ্ছে ছিল, দৌড়ে নাম করবে, চাকরি পাবে। কিন্তু হল কী অনেক ঘোরাঘুরি করেও সে কলকাতার কোনও অ্যাথলেটিক ক্লাবে ঢুকতে পারল না। কেউ পাত্তাই দেয় না তাকে। মহকুমা আর জেলাস্তরে কিছু নাম হয়েছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তবে সে চেষ্টা ছাড়েনি। এখনও সে ভোররাতে উঠে দৌড়োয়, প্র্যাকটিস বজায় রাখে। দিন সাতেক আগে স্ট্যামিনা বাড়ানোর জন্য সে একটা রেললাইনের টুকরো দড়ি দিয়ে কোমরের সঙ্গে বেঁধে সেটাকে ছেড়ে দৌড়োনোর চেষ্টা করেছিল। বেহিসেবি আন্দাজের ফল যা হয়। লোহাটা ছিল দারুণ ভারী। দৌড়োতে গিয়ে খিচ লেগে যায়।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে কুঁচকির ব্যথাটা কমানোর চেষ্টা করল অতীশ। ব্যথা কমল বলে মনে হয় না। তবে ঘাড়ে বোবা নেই বলে একটু আরাম লাগছে।
বিড়ি শেষ করে পরান বলে, চলুন, রওনা হই। এখন না বেরোলে গাড়ি পাব না।
ঠিক আছে। চলো।
বস্তাটা ধরে মাথায় তুলে দেব কি? না কি সম্মানে লাগবে?
সম্মানে লাগবে।
তা হলে নিজেই তুলে ফেলুন।
বোঝাটা নামানোর পর ঘাড়ে টনটনানিটা টের পেতে শুরু করেছে অতীশ। এর আগেও অন্যান্য আবাদ থেকে বার কয়েক বজি নিয়ে গেছে। তবে ব্যাপারটা তার এখনও অভ্যাস হয়নি। পরান বলে, ধীরে ধীরে ঘাড় শক্ত হয়ে যাবেন। বামুনের ঘাড় এমনিতেই শক্ত। সহজে নুইতে চায় না।
অতীশ ক্রমশ বুঝতে পারছে ব্রাহ্মণত্ব আর বজায় রাখা যাচ্ছে না। বাবা মেলা বামনাই শিখিয়েছিল তাকে। যজমানি বামুন বলে কথা। কিন্তু সে সব যেতে বসেছে পেটের দায়ে।
বস্তাটা প্রথমে হাঁটুর চাড়ে পেট বরাবর, তারপর দুহাতের ঝাঁকিতে মাথায় তুলতেই ভারী টালমাটাল খেয়ে যায় অতীশ। ঘাড়ে মচাক করে একটা শব্দ হল নাকি? সরু রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল।
পরান অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে তার বোঝাটি মাথায় তুলে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে। বলল, মাঝবরাবর হয়নি, ডানধারে কেতরে আছে। একটা ঝাঁকি মেরে একটু বাঁয়ে নিন। নইলে কষ্ট হবে।
ব্যালান্স রাখাই কষ্ট। বস্তাটায় ঝাঁকি মেরে মাঝবরাবর করার চেষ্টা করল সে। বিড়ে নেয়নি বলে মাথায় বেগুনের বোঁটা খোঁচা মারছে। বিড়েটা নিল না লজ্জায়। প্রেস্টিজে লেগেছিল। মাথায় বিড়ে নেয় তো কুলিরা। সে কেন নেবে?
পরান বলেছিল, বিড়ে না নিলে মাথায় চোট হয়ে যেতে পারে।
কুঁচকির কষ্টের সঙ্গে ঘাড়ের কষ্টটাও যোগ হল। পরান আগে হাঁটছে এবার, পিছনে অতীশ। অনেক কিছু পারতে হবে তাকে এখন। অনেক কষ্ট সইতে হবে। মানুষ সব পারে। কত শক্ত শক্ত কাজ করছে। স্টেশনের কুলিরা এর তিন ডবল মাল টানে অহরহ।
কুঁচকিটা এবার যাবে। ডান হাঁটু মাঝে মাঝে নুয়ে পড়ছে ব্যথায়।
যদি সুবল মহাজন ঠিকঠাক দাম দেয় তবে মায়ের হাতে গোটা চল্লিশেক টাকা দিতে পারবে আজ। পঁচিশ কেজির মাল থেকে যদি ছাপ্পান্ন টাকা চার আনা লাভ হয় তবে খরচ খরচা বাদ দিয়ে ওরকমই থাকবে। কিন্তু ঠিকঠাক কত থাকবে তা বলা কঠিন।