জীবনসংগ্রাম কাকে বলে জানো? এই সংগ্রামটা নিজেই করতে হয়। সব জায়গায় তো আর পরানচন্দ্র দাসকে পাওয়া যাবে না।
পরানের পায়েও হাওয়াই চটি, লুঙ্গিটা অর্ধেক ভাঁজ করে ওপরে তুলে কোমরে গুঁজে নিয়েছে বলে বা ঠ্যাংদুটো দেখা যাচ্ছে। গায়ে একটা হাওয়াই শার্ট। পরান বেঁটে এবং খাঁটিয়ে পিটিয়ে তোক। ইসল। বলল, বেগুন নিয়ে যদি পড়েন তো বেগুনও গেল, আপনিও গেলেন। আমার অভ্যাস আছে। একটু দাঁড়ান।
এই বলে পরান অতীশকে ডিঙিয়ে সাঁকোতে উঠে পড়ল। ওপাশ থেকে বিড়ি মুখে একটা লোক সকোতে উঠতে গিয়ে পরানকে দেখে সরে দাঁড়াল।
অতীশ নিবিড় চোখে পরানকে লক্ষ করছিল। কায়দাটা কি খুব কঠিন? বাঁশে একটা মচমচ শব্দ হচ্ছে, একটু একটু দেবেও যাচ্ছে। পরান একটা আলতো হাত বাঁশের রেলিঙে রেখে পা দুটো সামান্য ঘসটে ঘসটে পেরিয়ে যাচ্ছে। ওর বস্তায় ত্রিশ কেজির মতো বেগুন।
অতীশ দেরি করল না। ঠাকুর স্মরণ করে অবিকল ওই কায়দায় সাঁকোতে উঠে পড়ল। বাঁশের সাঁকোতে একটা ম্যাক করে জোর শব্দ হল। একটু কাঁপল কি? পরান নয়, ওপাশের লোকটা হঠাৎ হেকে বলল, দাঁড়াও বাপ, দুজনের ভর সইবে না। আক্কেল নেই তোমার?
আড়চোখে খালের দিকে চাইল অতীশ। ছোট খাল। জল কম, কিন্তু কাদা থিকথিক করছে। পড়লে গলা অবধি গেথে যাবে।
সাঁকোর ওপর দু কদম এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অতীশ। পরান ওপারে পা দিতেই সেও ধীরে ধীরে পা ঘসটে ঘসটে এগোতে থাকে। বাঁ হাতে আলতো করে রেলিং ধরা। পারবে না? এসব না শিখলে তার চলবে কেন?
ওপার থেকে পরান বলল, কথা শুনলেন না তো! পারবেন কি? নইলে বলুন, আসি।
না। পারব।
পারার জন্য যেটা দরকার সেটা হল অখণ্ড মনোযোগ। পা যাতে বেচাল না পড়ে আর শরীর যাতে হেলে যায়। ডান কুঁচকিটা ঠিক থাকলে কোনও চিন্তা ছিল না। কিন্তু টাটানিটা যেন বাড়ল সাঁকোর মাঝবরাবর এসে। অবশ লাগছে, দুর্বল লাগছে ব্যথার জায়গাটা। দাঁতে দাঁত চেপে সে মনে মনে বলল, যতই কামড়াও আমি ছাড়ছি না। তুমি ব্যাটা আমার চাকর, যা বলব শুনতে হবে।
ডান কুঁচকি এই ধমকে ভয় পেল বলে মনে হয় না। তবে অতীশ মাঝ-সাঁকো থেকে সামান্য ঢালে সাবধানে পা রাখল। বড় নড় করছে সাঁকোটা, এত ওজন তার যেন সওয়ার কথা নয়।
হড়বড় করবেন না, ধীরে সুস্থে আসুন। নীচের বাঁশে দড়ির বাঁধন আছে, বাঁশের গিট আছে, সেগুলোর ওপর পা রাখুন। পা একটু আড় ফেলবেন। দুই বাঁশের মাঝখানে পা ফেললে বাঁশ ফাঁক হয়ে পা ঢুকে যেতে পারে। পুরনো বাঁধন তো, তার ওপর মাথায় অত ওজন।
পরান বরাবরই একটু বেশি বকবক করে। এসব কি আর সে জানে না? প্রাণের দায়েই জানে। প্রাণের দায়ই তো যত আবিষ্কারের মূল।
ঢালের মুখে ডান পা একটু পিছলে গেল হঠাৎ। বুকটা কেঁপে উঠে মাথা অন্ধকার হয়ে গেল তার। এই রে! গেলাম!
কিন্তু পাটা একটা বড় বাঁধনের দড়িতে আটকাল। বস্তাটা একটু দুলে গিয়েছিল। দাঁড়িয়ে দোলটা সামাল দিল অতীশ। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে লাগল। শালার ডান কুঁচকি কুকুরের মতো কামড়াচ্ছে। জায়গাটা ফুলে উঠল নাকি?
একেবারে শেষ দিকটায় পরান এগিয়ে এসে বস্তাটা ধরল।
অতীশ একটু রেগে গেল। অযাচিত সাহায্য সে পছন্দ করে না। বলল, ধরলে কেন? পেরিয়েই তো এসেছিলাম।
পরান অতীশকে চেনে। একটু ভয়ও খায়। বলল, একেবারে শেষ সময়ে মাঝে মাঝে ভরাডুবি হয় যে।
ইংলিশ চ্যানেল পেরোনোর সময় কোনও সাঁতারুকে স্পর্শ করা বারণ। করলেই সেই সাঁতারু ডিসকোয়ালিফায়েড। এইরকমই শুনেছে অতীশ। তার মনে হল, এই সাঁকো পেরোনোতেও সে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে গেল পরানের জন্য।
পরান তার বস্তাটা নামিয়ে রেখেছিল। তুলতে গিয়েও থেমে বলল, আপনি বড্ড ঘামছেন। একটু জিরিয়ে নেবেন নাকি?
অতীশ টের পাচ্ছে তার ডান পা থরথর করে কাঁপছে। কুঁচকির ব্যথার জায়গাটা জ্বলছে লঙ্কাবাটার মতো। আর মাইলটাক বয়ে আনা বেগুনের বস্তার ভারে কাঁধ ছিঁড়ে পড়ছে। তবু বলল, আমার জিরোনোর দরকার নেই।
পরান বলল, আরে, তাড়া কীসের? গাড়ি সেই ছটায়। একটু বিড়ি টেনে নিই। দিন বস্তাটা ধরে নামাই। পট করে ফেলবেন না যেন। চোট লাগলে বেগুন দরকচা মেরে যায়।
বস্তাটা নামিয়ে ঘাসজমির ওপর রাখল অতীশ। তারপর চারদিকে চাইল। বেশ জায়গাটা। উঁচু মেটে রাস্তার দুধারে পতিত বুনো জমি। বসতি নেই। গাছপালা আর এবড়ো খেবড়ো জমি।
লোকটা খাল পেরিয়ে ওধারে চলে গেছে। চেয়ে দেখছিল অতীশ। ওপাশে আবাদ। কত লোক কত ভাবে বেঁচে আছে।
পরান পথের ধারে হেলানো বাকলা গাছের গোড়ার ওপর বসে বিড়ি ধরিয়েছে। বিড়ি ধরানোটা অছিলা। এই ফাঁকে অতীশকে একটু জিরেন দিতে চায়। ও কি ভাবে অতীশ কমজোরি, পরেসান? এইটেই অতীশ সহ্য করতে পারে না। সে কি ওর করুণার পাত্র?
পরান বিড়ি খেতে খেতে বলল, এ আপনার পোষাবে না বাপু। এই গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে গিয়ে পাবেন ক পহা? বরং পুরুগিরিতে লাভ।
পরানের কথায় কান না দিলেও চলে। পরান হচ্ছে নীচের তলার লোক। ওর সমস্যা কম। দেহখানি পাত করে ওকে খেতে হয়। ভদ্রলোকদের গতর খাটাতে দেখলে ও ফুট কাটবেই।
অতীশের রিক্সা গত এক সপ্তাহ নেই। পুজোপাটেরও বরাত নেই। সংসারটা চলে কীসে? পরান বলল, ভুবনডাঙার বেগুন এনে বেচলে কেজিতে দু টাকা চার আনা করে লাভ। তাই আসা।